আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে যে নিদ্রিত ভারত জেগে উঠেছিল তাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। স্বাধীনতা একটা কনসেপ্ট। সম্ভবত মনুষ্য মনস্তত্ত্বের যে বিষয়গুলি নিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায়— স্বাধীনতা তারই মধ্যে একটি; হয়েও আসছে সেভাবেই। অতি অল্প কথায় ভাবলে— রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ অভিমানসহ আরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মতই স্বাধীনতাও হল মানুষের বোধের ভিতরে থেকে যাওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী এক অনুভূতি। ঠিক যেমন বলপ্রয়োগ করে কোনও মানুষের অন্তর থেকে ভালবাসার অস্তিত্ব মুছে দেওয়া যায় না, তেমনই স্বাধীনতা হরণ করা বা দান করাও যায় না। স্বাধীনতা হল স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপচে আসা বোধের এক খরস্রোতা নদী! প্রকৃত স্বাধীন সে-ই যে অন্যের স্বাধীনতার অধিকারকে সম্মান করতে পারে। তাই আজাদি ঝুটা হতেই পারে না, আজাদি মানে তা সচ্!

      আমরা যারা শৈশবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের উদযাপন দেখেছি তারা বুঝেছি উদযাপনে মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা বড় প্রয়োজন। সেকালে সমস্ত বিষয়টার মধ্যে একটা আটপৌরে আন্তরিকতা ছিল; একটা অগোছালো ভালবাসা ছিল। সকালে প্রাইমারি স্কুলগুলো থেকে প্রভাত ফেরি বেরোত। স্কুলের বাচ্চারা লাইন দিয়ে প্রভাত ফেরি করত। সবার ঠিকঠাক ইউনিফর্মও থাকত না। সে লাইন-খানিক দূর যাওয়ার পরেই এলোমেলো হয়ে যেত। ‘বন্দেমাতরম’ ‘জয় হিন্দ’ বলে গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করত বাচ্চারা; সে চিৎকারে ছন্দ ছিল না, প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু একটা ভালবাসা থাকত। স্কুলে কলেজে অফিসে পতাকা তোলা হত। কড়া নির্দেশের চিঠি আসত না, চমকে দেওয়া মেইল আসত না। যেটুকু হত ভিতর থেকেই হত। ত্রুটিহীনতা প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়; তাই ত্রুটি থাকত হয়তো কিন্তু একটা আনন্দবিহ্বলতার চোরা স্রোতও থাকত বৈকি! একটা ফুলস্কেপ কাগজে মোম রঙ দিয়ে পতাকা এঁকে সেটা পাটকাঠির আগায় আটকে পতাকা বানিয়ে গ্রিলে আটকে দেওয়ার মধ্যে উদযাপনের আতিশয্য ছিল না কিন্তু সারল্য ছিল।

   ভারত নর্থ কোরিয়া নয়, ভারত আমেরিকা নয়, ভারত কোনও কর্পোরেট হাউসের নাম নয়— সারা ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা (যেক’টি এখনও রয়ে গিয়েছে) এবং রাজ্যভেদে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমেও পতাকা বিক্রি করা হল। কর্মীদের পতাকা বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হল, সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কর্মীরা উপভোক্তা বা ক্রেতাদের জোর করলেন— এটা পদ্ধতি নয়। ভারতের মত দেশের ক্ষেত্রে এপদ্ধতি অচল। স্বাধীনতা দিবস অনুভবের, প্রতিযোগিতার নয় এই দেশের মানুষ আজীবন তাঁদের দেশকে ভালবাসেন— এটা বিশ্বাস করতে হবে। দেশপ্রেম কোনও পরীক্ষা নয়; প্রতিযোগিতা নয়, এর কোনও মার্কশিট হয় না, কোনও শংসাপত্র হয় না। স্কুলে অফিসে পতাকা উত্তোলন করে তা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করলে কী প্রমাণ হয় বলুন তো? নিজের সন্তানকে কটা চুমু খেলেন বা মা-বাবাকে কবার প্রণাম করেন তা গুনে রেখে রেখে কি প্রমাণ করা যায় ভালবাসার ডেপথ্?

        ভেবে দেখলে অবাক হতে হয় মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর থেকে কেরলে প্রবাহিত দেশপ্রেমে ‘বন্দেমাতরম’ই উচ্চারণ করা হয় কিন্তু বিভিন্ন ভাবে। ‘জনগণমন’ গাওয়া হয় তাও বিভিন্ন উচ্চারণে। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন উচ্চারণে গাওয়া জাতীয় সঙ্গীত গায়ে কাঁটা দেওয়া অনুভূতি তৈরি করে। একটু তাকিয়ে দেখুন, ওই যে একটা কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসি বাচ্চা, আধ-ন্যাংটো হয়ে ছুটছে জমির আলপথে, হাওয়ার জোরে লেপ্টে আছে বুকের উপর পতাকা; কফিনমোড়া জাতীয় পতাকায় চুমু খাচ্ছে যুবতী; এককৌটো চকলেট আর ছোট্ট ছোট্ট কাগজের পতাকা কিনে বৃদ্ধ বিলিয়ে দিচ্ছেন বাচ্চাদের মধ্যে। বিশ্বাস করুন এসব পতাকার দাম কয়েকশো কোটি বা তারচেয়েও বেশি! তাই ভারতের মেরুদণ্ডই হল বিভিন্নতা। বিভিন্নতা বাঁচলে স্বাধীনতা বাঁচবে আর তবেই মাথা তুলবে গণতন্ত্র।