ভোরের আলো ফোটার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে নারকেলের ঝাঁটা দিয়ে এক কোণে আবর্জনাগুলো জড়ো করে জল ছিটিয়ে দিতেন উঠোন জুড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে একে একে ছেলে-মেয়েদের ঘুম থেকে তুলতেন, তারপর তড়িঘড়ি ঢুকে যেতেন রান্নাঘরে।
এই দৃশ্যের পরিবর্তন দেখা যেত না কোনও ঋতুতে। কোনোরকমে টেনে চলা সংসারটাকে নিজের বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলেন। বাবা সকালেই বেরিয়ে যেতেন কাজে। খাবার তৈরি থেকে শুরু করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে তাঁর হাতে তুলে দিতে কোনও দিন ভুলতে দেখা যায়নি। সংসার-স্বামী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভাবনার শেষ ছিল না। সেলাই-ফোঁড়াইয়ের দিকে নজর ছিল তীক্ষ্ণ। দুপুরের খাওয়া শেষ হলে খাটের ওপরে পা ছড়িয়ে বসতেন সেলাই নিয়ে। সূচ আর বিভিন্ন রঙের সুতো নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়তেন নিমেষে। এতটা নিবিড় হয়ে পড়তেন যে বড্ড অচেনা লাগত তাঁকে। সাদা কাপড়ের টুকরোর ওপরে কত কিছু ফুটিয়ে তুলতেন। বিভিন্ন উপদেশ লিখতেন ওই সূচ আর সুতোয়।
শীতকালে পড়ন্ত বিকেলে উঠোনের যেদিকে রোদ এসে পড়ত, সেদিকে বড় বড় দুটো মাদুর পেতে হাতের কাজে মেতে উঠতেন পড়শি জেঠিমা-কাকিমাদের সঙ্গে। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে কত রকম সূচিশিল্পের দেখা মিলত।
সাদা কাপড়ে লাল আর নীল সুতোয় লেখা “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বাবা। বাবার হাতে ধরা ফ্রেমটা দেখে তাঁর মুখে অদ্ভুত একটা আলো খেলে গিয়েছিল। মুহূর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি রান্নাঘরে ঢুকে জলচৌকির ওপর বসে সবজি কাটতে শুরু করেন। বাবা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর খানিকটা উঁচু স্বরে বড়দির নাম ধরে হাঁক দেন।
ফ্রেমটা ঘরের দেওয়ালের একদিকে পেরেক পুঁতে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। বাড়িতে কেউ এলেই বাবা যে ভাবেই হোক দেওয়ালে ঝুলে থাকা তাঁর হাতের কাজ দেখিয়ে তবে ক্ষান্ত হতেন । যে কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে আমাদের উপহার দেওয়ার রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর হাতে তৈরি নানা ধরনের সূচিশিল্প।
শুধুমাত্র সংসার নয়, পাড়া প্রতিবেশীদের বিপদে-আপদে পাশে থাকতে দেখা যেত তাঁকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নামটাও বদলে যেতে লাগল। সবাই ‘সেলাই-বউদি’ বলেই ডাকত। তাতে তাঁর যে খুব একটা আপত্তি ছিল—তা নয়। বরং ওই ডাক শুনে মনে মনে খুশি হতেন বাবা।
একবার পাড়ার স্পোর্টসে তাঁকে জোর করে নামিয়েছিল জেঠিমা, কাকিমারা। ইভেন্টের নাম ছিল ‘হাঁড়ি মাথায় দৌড়’। বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে গামছা এনে মাথায় বিড়া বেঁধে দিয়েছিলেন। ফাঁকা হাঁড়িটা বসিয়ে দু’পা হেঁটে পরখ করে নিতে ভোলেননি। দৌড় শুরু হতেই আমরা ভাই-বোনেরা রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন ফিনিশিং লাইনের একদম কাছে। তারপর কী হল কে জানে! হাঁড়িটা মাটিতে পড়ে দু’ভাগ। সেইসঙ্গে আমাদের উত্তেজনা একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছল। বাবাকে আর দেখা যায়নি ধারে-কাছে। তবে দৌড় শেষে তিনজন স্থানাধিকারী জেঠিমা, কাকিমাদের জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি।
বিশ্ব সংসারের ভারের কাছে হাঁড়ির ভার নিতান্তই নগণ্য; হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলেন সব কিছু। আমার মা তাই কখনও পুরস্কার পাননি।