“হ্যালো… কে?”
“চিনতে পারছিস না গলা শুনে? বল্ তো কে?”
“খুব চেনা লাগছে, সুবিমল?”
“যাক! তাহলে চিনতে পারলি। কী খবর বল।”
“কোনও খোঁজখবর নেই, কোথায় এতদিন হারিয়ে গেলি? হঠাৎ এখন ত্রিশ বছর পর এসে খবর জিগেস করছিস?”
“দ্যাখ অনিমেষ, তুইও তো কোনও যোগাযোগ রাখিসনি এতদিন। দোষ কি আমার একার?”
“না… সে ঠিক আছে, দোষ উভয়পক্ষের। তা এখন ফোন করলি কি ঝগড়া করবি বলে? আমার নাম্বার কোত্থেকে পেলি?”
“আরে, নারে ভাই, সব বলব, একদিন কোথাও আয় না, একটু বসি।”
“বল্ কোথায় বসবি? আমি চলে যাব।”
“কলেজের পাশে সেই স্বপ্না কেবিনে। শনিবার বিকেল চারটে, আসতে পারবি?”
“ওকে, ডান্। ফোন করে নেব।”
ফোন কেটে পকেটে মোবাইল রাখতে গিয়ে অনিমেষের চোখ গেল তারিখের দিকে। আরে! শনিবার তো এক তারিখ! মৌমিতার সাথে একটা ফ্ল্যাট দেখতে যাবার কথা। অনেকদিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল। এখন ম্যানেজ করতে হবে। তবু কথা যখন দিয়েছে ছোটবেলার বন্ধু, নিশ্চয় যাবে। পুরোনো অনেক কথা মনের মধ্যে কিলবিলিয়ে উঠতে লাগল। কেটে গেল ক’দিন। এসে গেল শনিবার।
সেদিন কুয়াশার চাদর ভেঙে রোদ সকাল থেকে উঠতেই পারছে না। সময় গড়াচ্ছে, দিন তবু সাবালক হয়ে উঠতে পারছিল না। দুপুরের পরেই ফোনাফুনি। ঠিক চারটেতে দুই বন্ধু তিরিশ বছর পর আবার সেই স্বপ্না কেবিনের ডানদিকের কোণের ছোট্ট টেবিলে। সব একইরকম আছে। শুধু ফাঁক দিয়ে অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেছে। চুলে পাক ধরিয়ে দিয়েছে কাউন্টারে বসা লোকটার। চশমার কাচ মোটা হয়ে গেছে। দেওয়ালের ছবিগুলো অনেক মলিন। টেবিল-চেয়ারগুলো বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একটা গাম্ভীর্য গেঁড়ে বসেছে আড্ডায়। সেই তিরিশ বছর আগের উচ্ছ্বাসটা নেই, একটা পরিণত হিসেবি গল্প শুরু হল।
“তোর খবর বল অনিমেষ?”
“আমার নাম্বার কীভাবে পেলি বল?”
“আরে আমার বড় ভায়রা ইউকো ব্যাঙ্কে আছে। আমি একদিন কথায় কথায় তোর কথা বলি। আমার এক বন্ধুও আছে তোমাদের ব্যাঙ্কে, নাম অনিমেষ মিত্র। একটু খোঁজ লাগাও না। কিছুদিন পর উনি আমাকে তোর নাম্বারটা যোগাড় করে দেয়। বলে এখন গড়িয়া ব্রাঞ্চে আছে। তারপরেই তোকে ফোন করি। তারপর তোর সংসারের গল্প বল্।”
“সংসারের গল্প আর কী বলব? আমার সংসারের গল্প ভালো নয়। আমার এক মেয়ে, এখন লেডি ব্রেবোনে পড়ে। বউ একটা স্কুলে পড়ায়, বারুইপুরে, সরকারি স্কুল। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বাবা-মায়ের বয়স হয়ে গেছে, স্বভাব এখন খিটখিটে। সারাক্ষণ বাড়িতে শাশুড়ি-বউতে ঝামেলা। মৌমিতা সবসময় বলে, চলো আমরা আলাদা ফ্ল্যাট কিনে চলে যাই। আমার মন চায় না। এই নিয়ে দিনরাত অশান্তি। নিজের অফিসের টেনশন। মাঝেমধ্যে আর নিতে পারি না রে, অসহ্য লাগে। বাদ দে ঐসব, তুই তোর কথা বল।”
“না ভাই, আমার ওসব কোনও ঝামেলা নেই। আমার বাবা-মা অনেকদিন হল গত হয়েছেন। একটি মাত্র ছেলে, তা-ও খড়্গপুর হোস্টেলে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বউ নার্সিং স্টাফ্, নীলরতনে আছে। আমার ব্যবসাও ঠাকুরের কৃপায় মোটামুটি চলে যাচ্ছে। এখন আমি ঝাড়া হাত-পা। ভালোই আছি। এই দেখ-না বউ আর ছেলের ছবি।”
“বাঃ, তোর ছেলে বেশ ফর্সা হয়েছে তো!”
বলতে বলতেই অর্ডার দেওয়া ফিসফ্রাই দিয়ে গেল টেবিলে। সুবিমলের বউয়ের ছবিটা খুব চেনা লাগল অনিমেষের। মনের গভীরে হাতড়াতে লাগল, কোথায় দেখেছে… মেলাতে পারছে না। ফিসফ্রাই-এর ওপরের প্রলেপ ভেঙে মাছের ফিলে যত বেরিয়ে আসতে লাগল, দু’জনের জীবনের অনেক মেকি পর্দা সরে যেতে লাগল। ‘সত্যি’ সব গল্প ভাগাভাগি হতে থাকল। জীবনের নানা ওঠাপড়া, চাকরির প্যাঁচ-পয়জার, পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা। হঠাৎ অনিমেষের মনে পড়ে গেল মেয়েটির মুখ। এ’টা সঙ্গীতা না? জিগেস করল, “আচ্ছা সুবিমল, তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায়?”
“কেন? উত্তরপাড়া।”
“উত্তরপাড়া কোথায়?”
“শখেরবাজার।”
“আরে ওখানে তো আমার মেজ মামার বাড়ি। একসময় খুব যেতাম। তোর বউয়ের নামটা কী বলতো?”
“সঙ্গীতা। চিনতিস নাকি?”
ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। কিন্তু ওর মনের ফাটল থেকে ফিনকি দিয়ে সব স্মৃতি ছিটকে আসছে। স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সব মনে পড়ছে। ছেলেটির নাম ছিল মৃন্ময়। ডাক্তারি পড়ত। সঙ্গীতার বেশ তখন চটক ছিল। স্বাভাবিকভাবেই চোখ পড়েছিল অনিমেষের। পরে খবর নিয়ে জেনেছিল, এ পাখি ইতিমধ্যেই জোড় বেঁধে বসে আছে। ওরা সমবয়সী ছিল; সবাই জানত ওদের বিয়ে হবে। ওদের বহুদিন গঙ্গার ধারে হাত ধরাধরি করে দেখা গেছে। পরে কানে এসেছিল, সঙ্গীতার নাকি অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে। তখনও মৃন্ময়ের পড়া শেষ হয়নি, মাস্টার্স করছে। তাছাড়া ওদের দু’বাড়ির সম্পর্কও নাকি ভালো ছিল না। এর বেশি আর কিছু জানা নেই অনিমেষের। ওটা কোনও ব্যাপার নয়, অনেকেরই ওরকম ইতিহাস থাকে। ওসব ভেবে লাভ নেই। সুবিমল সুখী—এটাই যথেষ্ট। হঠাৎ সম্বিত ফিরল সুবিমলের গলায়, “কী রে! কী ভাবছিস?”
“কিছু না… এমনিই। এবার উঠব।”
“দাঁড়া-না… এতদিন পর দেখা, আর একটু বোস্। দুটো কফি বলি। দেরি হলে বউ বকবে?”
“বউ আর নতুন করে কী বকবে। সবসময়েই শাসন, সব ব্যাপারেই কড়া।”
“আমার ভাই এসব ঝামেলা নেই। আমরা কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলাই না, ফলে নো অশান্তি নো ঝঞ্ঝাট। বউ তো ওর অফিসের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে মায়াপুর গেছে, আমি যত দেরি করে ফিরব, ততই ভালো। বাড়ি গিয়ে তো সেই আবার একা। তবে সকাল থেকে তিনবার ফোন করা হয়ে গেছে। খবর সবসময় নেয়। কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না। এমনিতে খুব ডিউটিফুল।”
“বিউটিফুল! সত্যিই তুই খুব ভাগ্যবান। আমার বউটা যদি একটু বুঝতো, বাবা-মা আর কদ্দিন!”
“চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কী করে ঠিক হবে বল্! হয় আমার বাবা-মাকে মরতে হবে, নয় আমাকে আলাদা হতে হবে। এছাড়া তো আর কোনও পথ নেই।”
“না না, এতটা টেনসড্ হচ্ছিস কেন? একটা সমাধান সূত্র ঠিক বেরোবে।”
“না, মাঝেমাঝে ভাবি আমাদের তো কোনও অভাব নেই, তা-ও অশান্তি পিছু ছাড়ছে না। ভালো লাগে না আর!”
বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠল সুবিমলের। সুবিমল হেসে উঠল, “ম্যাডামের ঘুরতে গিয়েও, মন পড়ে আছে সংসারে। হ্যালো, বল… কী বলছ?… তুমি কি বাড়ি ফিরেছ? রুটি কিনে নিয়ে ঢুকেছ?… আরে না না। আড্ডা দিচ্ছি। তোমাকে সেই বলেছিলাম না, আমার ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল অনিমেষ। ব্যাটাকে আজ পাকড়াও করেছি, ওর সাথেই রয়েছি। দেরি করে ফিরব। তোমাদের কী খবর বলো। কেমন ঘুরছ?”
“দারুণ! হেভি মজা করছি। পরে একবার তোমাকে নিয়ে আসব।”
“অনিমেষের সাথে আলাপ করবে? এই নাও কথা বলো।”
এই বলে ফোনটা স্পিকারে দিল সুবিমল।
“নে অনিমেষ কথা বল্… সঙ্গীতা, কথা বলো।”
অনিমেষ আর সঙ্গীতার আলাপ পর্বের ফাঁকে হঠাৎ ফোনের ভেতর একটা ডোর বেল্ বেজে উঠল। সঙ্গীতা বলে উঠল, “সরি, একমিনিট।”
একটা পুরুষকন্ঠ—খুব সম্ভবত ওয়েটার। সঙ্গীতার বিরক্তির সুর, “কী চাই?”
“না মানে, ডাক্তারসাব সি-বিচ্ থেকে ফেরার সময় রুমে দুটো কফির অর্ডার দিয়েছিলেন।”
ফোনটা কেটে গেল। দু’জনের কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। ঠিক দু’জনের মুখের কাছে এসে ধোঁয়া দুটো পেঁচিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা মোটা প্যাঁচালো ধোঁয়া হয়ে সিলিং-এর দিকে উঠে যাচ্ছে। বোধহয় চেষ্টা করছে সিলিং ফুঁড়ে আকাশের দিকে হারিয়ে যেতে। সুবিমল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অনিমেষের দিকে। অনিমেষ হাতের ওপর হাত রেখে বলে, “নে কফি খা, টেক্ ইট্ ইজি।”