লেখক – আদিত্য গুপ্ত |
সে এক অদ্ভুত সময়। বিদ্যুৎ নেই, দ্রুতগতির যানবাহন নেই। এক ঢিমেতালের লয়ে এগিয়ে চলত জীবন। খাস কলকাতা শহরের বুকে সন্ধে হলেই এসে জমত ঝুঁঝকো অন্ধকার। শহরের রাস্তায় রাস্তায় যে সব আলো জ্বলত, সে আলোদের হিম্মত ছিল না সেই অন্ধকারের পুরোটা দূর করে।
এরকমই ছিল সেই সময়টা। ইংরেজদের হাতে পরাধীন, নিজেদের মেরুদণ্ডের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা এক জাতি অন্ধকারের মধ্যে নিজেদের মুখ লুকিয়ে রেখেছিল। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, সতীদাহ, পুরীর জগন্নাথের রথের তলায় আত্মবলিদান নানা রকম বীভৎস ঘটনায় ভরে ছিল চারপাশ। এর মধ্যেই অন্যতম ছিল নরবলি। সেই সব নরবলির বিবরণ আজও তখনকার খবরের কাগজ ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। অবিভক্ত বাংলাদেশের নানা প্রান্তেই নিয়মিত ঘটে চলত নৃশংস নরবলি।
যেমন ১৮২২ সালের ২২ জুনের ‘সমাচার দর্পণ’-এ পাওয়া যায় নদিয়ার জয়াকুঁড় গ্রামের জনৈক রূপরাম চক্রবর্তীর মৃত্যুসংবাদ। জানা যায়, তাঁকে খুন করা হয়েছে পাশের গ্রাম আড়বান্দাতে। খুনের মোটিভ ‘বলিদান’! এ ব্যাপারে আড়বান্দা গ্রামের জনৈক গৌরকিশোর ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করা হলেও শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়েও দেওয়া হয়।
১৮৩৭ সালের ২১ জানুয়ারি। বর্ধমানের রুক্মিণী দেবীর মন্দিরে ভোরবেলা পুজো দিতে এসেছেন পূজারি ব্রাহ্মণ। অচিরেই তিনি আবিষ্কার করেন দেবীমূর্তির আশপাশের অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাপ চাপ রক্ত! দেবীর সামনে নিবেদন করা হয়েছে স্বর্ণমুদ্রা ও নানা ধরনের সোনার গয়না, একহাজার রক্তজবা ও আরও নানা ধরনের নিবেদন সামগ্রী। এর ক’দিন পরেই মন্দিরের পাশের এক পুকুর থেকে উদ্ধার হয় এক মুণ্ডহীন শব! সকলেই বুঝতে পারলেন, এই মানুষটিকেই বলি দেওয়া হয়েছিল দেবীর সামনে। কিন্তু বলি দিল কে? বর্ধমানের চারটে থানার পুলিশ মিলে অনেক তদন্ত চালিয়েও শেষ পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি। যদিও সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছিল, এত বিপুল দানধ্যানের সঙ্গে বলি দেওয়ার ক্ষমতা খুব বড় কোনও লোকেরই আছে। তাঁদের সন্দেহ ছিল তৎকালীন বর্ধমানের রাজাকে। কেননা, তার কিছুদিন আগেই তার ছেলের বসন্তরোগ (পক্স) হয়েছিল।
কেবল নদিয়া বা বর্ধমান নয়, এরকম উদাহরণ মিলবে অবিভক্ত বাংলার আনাচে কানাচে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বলির পিছনে উদ্দেশ্য থাকত প্রিয়জনের ব্যাধিমুক্তি বা ওই ধরনের কোনও মনষ্কামনা। আর বলির পিছনে থাকত বিরাট ধনী কোনও ব্যক্তির হাত। তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তিতেই হয়তো সাধারণ মানুষ মুখ বুজে থাকত। কারণ, সেসব নরবলির কোনও কিনারা হতে দেখা যায়নি। বহু অনুসন্ধান করেও পুলিশ উপযুক্ত প্রমাণ বা সাক্ষী জোগাড় করে উঠতে পারত না।
গোপাল ভাঁড়ের গল্পের দৌলতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আমরা ছোটোবেলা থেকেই চিনি। শোনা যায়, সেই রাজা নাকি একবার এক কাপালিকের পরামর্শে দু-তিন বছরের মধ্যে একহাজার নরবলি দিয়েছিলেন! এটা অবশ্য জনশ্রুতি। কোনও খবরের কাগজে এ নিয়ে কোনও রিপোর্ট বেরিয়েছিল বলে জানা যায় না।
এবার আসি কলকাতায়। একেবারে খোদ কালীঘাটেই নরবলির ঘটনার কথা শোনা যায়! কেবল মুণ্ডচ্ছেদ নয়, অনেকে নিজের জিভ দেবীর কাছে বলি দিতেন বলেও জানা যায়। রেভারেন্ড লং সাহেবের লেখাতে পাওয়া যায় ১৮৩২ সালের এক ঘটনার কথা। ছাগল বলি দিতে এক ব্যক্তি মন্দিরে পৌঁছোয়। সঙ্গের নাপিত চেপে ধরেছিল ছাগলটিকে। কিন্তু শেষমেশ সেই লোকটি হাতের খাঁড়া চালিয়ে দেয় সঙ্গের নাপিতের ওপরেই! হয়তো শেষ মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল ছাগল বলি দেওয়ার চেয়ে মানুষ বলি দিলে পুণ্য বেশি হবে। বেচারা নাপিত বুঝতেও পারেনি মাথার ওপর দুলতে থাকা মৃত্যুর পর্দা অবলা জীবটিকে ছেড়ে নেমে আসতে চলেছে তারই ওপরে। খুনিটিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিচারে রায়ে তার ফাঁসিই হয়েছিল।
বলি হত চিৎপুরের চিত্রেশ্বরী মন্দিরেও! শোনা যায় সেই মন্দিরের সেবায়েত মনোহর ঘোষের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে রামসন্তোষ ঘোষ কলকাতা ছেড়ে চলে যান। তাঁর বক্তব্য ছিল, সকালে মন্দিরে পৌঁছে বহু সময়েই তাঁর নজরে আসত ছিন্ন নরমুণ্ড! পুণ্যপ্রত্যাশী সেই সব ধর্মান্ধদের প্রতি ঘেন্নায় তিনি বর্ধমানে চলে যান।
একটা মিথ আছে, আগের যা, তার সবই ভালো। কিন্তু যতই পিছনে হটা যায়, দেখা যায় ধর্মান্ধতা, লোভ আর ক্ষমতা দখলের লড়াই ইতিহাসের পাতায় পাতায় এভাবেই ছিটিয়ে রেখেছে রক্তের দাগ।
(তথ্যসূত্র: উনিশ শতকের সমাজ ও সংস্কৃতি/ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়)