‘‘ফেরা যাবে না বলছে ফিরতি পথ।’’ ১ দিনের সফর শেষে ফেরার সময়ে এমন অনুভূতি হতেই পারে। আপনি হয়তো কলকাতামুখী এক ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। আর আপনাকে বারংবার ডেকে চলেছে এক টুকরো প্রাচীন ভারতবর্ষ। পুরাণ, পুজারি, পাণ্ডা আর ইতিহাস মাখা ভারতের এক প্রাচীন শহর ফিসফিসিয়ে আপনার কানে কানে বলছে, আর ক’টা দিন থাকলে হত।

সেদিন খবর পেলাম, আমার এক নিউইয়র্কবাসী বন্ধু বাবার পিণ্ডদানের উদ্দেশ্যে গয়া আসছে। উইকেন্ডে দিন তিনেকের ছুটি নিতে অসুবিধে ছিল না, তাই ফোনে আমায় যাওয়ার কথা বলতেই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে, অ্যাদ্দিন বাদে বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়ার সুযোগ ছাড়তে নারাজ ছিলাম।

গয়া আমি এর আগে যাইনি, পিণ্ডদানের গপ্পোই কেবল শুনেছিলাম। পাণ্ডাদের উৎপাত, দর্শনার্থীদের নাজেহাল অবস্থার তিক্ত বর্ণনা অনেকের থেকে শোনা। তাই মনে মনে তেমন কিছু অভিজ্ঞতার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু গোটা অভিজ্ঞতাই পাল্টে গেল কেবল একটা নামের জন্য। মেক মাই পিলগ্রিমেজ। নিউইয়র্কে বসেই ইন্টারনেটের দৌলতে যার সন্ধান পায় আমার বন্ধু। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, পিণ্ডদানের সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের হাতে সঁপে দিয়েই বিমানে চড়ে সে।

বন্ধুর মুখে মেক মাই পিলগ্রিমেজের সুনাম তো শুনেছিলাম, হাতে নাতে ফল পেতেও বিশেষ দেরি হল না।  তিন ঘণ্টা লেটে কলকাতা-আগ্রা এক্সপ্রেস যখন গয়া জংশনে নামায়, ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১১টা ছুঁই ছুঁই। তবে স্টেশনে নেমে বিপাকে পড়তে হয়নি। কারণ আমাদের সম্ভাষণের জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মেক মাই পিলগ্রিমেজের এজেন্ট। মাঝবয়সী ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম, রাম কিষাণ। তবে বাংলা দিব্বি বোঝেন। কথায় বুঝলাম, ট্রেন দেরিতে আসবে, তিনি  ১০০ ভাগ নিশ্চিত ছিলেন। এটাই নাকি স্বাভাবিক। বরং সময়ে আসলেই বিচলিত হতেন। যাই হোক, বিশেষ দেরি না করে গাড়িতে আমরা রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। প্রায়ান্ধকার পথে, তিলকূট, লিট্টি আর গোবরের গন্ধ মেশানো বাতাসে, মন্দির-হোটেল-পানমশলা-গৈরিক পতাকার ফাঁকফোকরে গয়ার সঙ্গে পরিচয় হতে থাকলো ক্রমে৷ প্রথম রাতেই।

হোটেলের বর্ণনা দিয়ে অহেতুক লেখার দৈর্ঘ্য বাড়াবো না। যারা মেক মাই পিলগ্রিমেজের সঙ্গে অতীতে ঘুরেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই হোটেলের মান সম্পর্কে অবগত। আর যারা ঘোরেননি, তাঁদের শুধু এটুকু বলব, ভারতের এক প্রাচীন শহরে এসেও বিলাসিতার যথেষ্ট সুযোগ পাবেন এখানে। ডিনার আগেই সারা ছিল, শোয়ার আগে দরকার ছিল এক কাপ চায়ের। বলতে না বলতেই সেটাও চলে এল। মোষের ঘন দুধ, পর্যাপ্ত চিনি, চা-পাতা আর হাল্কা এলাচের গন্ধ৷ বলতে পারি, এর কাছে আপনার দার্জিলিং টি-ও দশ গোল খেতে বাধ্য।

পরদিন সকালে ব্রেকফার্স্ট হতে না হতেই রুমের দরজায় টোকা। দরজা খুলতেই দেখা গেল আচারিয়া প্রবীণ পাঠক মহাশয়কে। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের কথা আগে থেকেই জানতাম। ইনি হতে চলেছেন আমাদের আজকের গাইড, একইসঙ্গে পুরোহিত। অর্থাৎ কোথায় গিয়ে, কোন পাণ্ডার হাত ধরে পিণ্ডদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, সে নিয়ে আলাদা করে ভাববার অবকাশই রাখেনি মেক মাই পিলগ্রিমেজ। মনে মনে খুশিই হলাম। যতদূর শোনা ছিল, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মাধ্যমে পিণ্ডদান প্রক্রিয়া সারতে এখানে ভিড় জমায় মানুষ। সে লাইনে যে আমাদের থাকতে হচ্ছে না, এ এক স্বস্তি বটে। আমার বন্ধুর থেকে বংশ পরিচয়, বাবার নাম, কুষ্ঠি ইতাদি জেনে কাগজে নোট করলেন বৃদ্ধ। এর পর আমাদের বললেন, পথচলতি বহু পাণ্ডার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। তাঁদের পাত্তা না দেওয়াই ভালও। তিনি সঙ্গে থাকতে বিশেষ কেউ বিরক্ত করার সাহস দেখাবে না।

কার্যক্ষেত্রে হলও সেটাই। যতক্ষণে পৌঁছলাম, এইটুকু সময়ের মধ্যে কোনও পাণ্ডাকে অসৎ উদ্দেশ্যে কাছে ঘেঁষতে দেখিনি। কারণটা বোধহয় আচারিয়া প্রবীণ পাঠকজি। প্রথমে পাঠকজি আমাদের নিয়ে গেলেন বিষ্ণুপদ মন্দিরে। গয়ার প্রধান মন্দির যেখান থেকে পিণ্ডদান প্রক্রিয়া শুরু হয়। পৌরাণিক এই মন্দিরের আনাচ কানাচে লুকিয়ে রয়েছে ঐশ্বরিক রহস্য। আমাদের কাজকর্ম মিটতে মিটতে প্রায় দুপুর গড়ালো। ধূপের ধোঁয়া, আতপ চাল ছড়ানো কলাপাতা, প্রাচীন গন্ধ মাখা মন্দির ছাড়িয়ে আমরা এগোলাম। শুকনো, আংশিক কাদাজলে ভেজা ফল্গু নদীর সামনে লাল পাথরের সিঁড়িতে বসে উপভোগ করলাম বাকি সময়টা। পেটে খিদে অনুভব হতেই বুঝলাম এখন গন্তব্য হোটেল।

এবার ফেরার পালা। আবার গয়া জংশন। রাতের চম্বল এক্সপ্রেস ধরে ফিরে আসা নিত্য জীবনের মাঝে। কেবল স্মৃতি হিসেবে বুকে রাখা এক টুকরো প্রাচীন ভারতবর্ষকে। এই বিশ্বাসেই, যে আবার দেখা হয়ে যাবে কোনও একদিন।