গল্প কুটির ওয়েব ডেস্ক।

সারা বছর ধরে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকারা অপেক্ষা করে থাকেন সরস্বতী পুজোর জন্য। প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে বিদ্যা-জ্ঞান-সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। সরস্বতী পুজো বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকলেও সেই সুদূর জাপানেও পূজিত হয়ে আসছেন দেবী সরস্বতী। প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে জাপানিরা হিন্দু দেবী সরস্বতীকে ‘বেঞ্জাইতেন’ নামে পুজো করে আসছেন। তাঁরাওল কিন্তু একইভাবে ভক্তিভরে বিদ্যার দেবীর আরাধনা করেন। আনুমানিক খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে জাপানে বেঞ্জাইতেন-এর পুজো শুরু হয়।

এবার নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জাগছে যে, আদতে কেমন জাপানি সরস্বতী। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দেবী সরস্বতীর যেমন রূপ, তার থেকে জাপানের বেঞ্জাইতেন-এর কিন্তু বিস্তর ফারাক। আপাদের চিরপরিচিত বাগদেবী চতুর্ভূজা হলেও দেবী বেঞ্জাইতেন-এর কিন্তু ২টি হাত। দুই হাত বিশিষ্ট বেঞ্জাইতেন মূর্তিই পুজোর প্রচলন রয়েছে জাপানে। পাশাপাশি দেবী সরস্বতী বাহন রাজহংসের ওপর বিরাজ করেন। সেদিক থেকে জাপানের অধিকাংশ জায়গায় বেঞ্জাইতেন-এর কোনও বাহন নেই। তবে কোথাও কোথাও দেবীমবর্তির সঙ্গে ড্রাগন, মন্তান্তরে সাপ দেখা যায়। তবে কেন দেবী সরস্বতীর বাহন সাপ তা নিয়েও কিন্তু যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। তবে পৌরাণিক কাহিনি ঘেঁটে জানা যায় যে, দেবী সরস্বতী বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন। ঋক বেদে বলা আছে এই বৃত্রাসুরের অপর নাম ‘অহি’ বা সাপ। আর সেই কারণেই হয়তো ড্রাগন বা সাপের ওপর বিরাজ করেন বেঞ্জাইতেন। তবে মিল রয়েছে বাদ্যযন্ত্রে। দেবী সরস্বতী ঠাকুরের হাতে থাকা বীণার মতোই বেঞ্জাইতেন-এর হাতে থাকে বিওয়া, এটি জাপানের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি বাদ্যযন্ত্র।

জানা যায়, আমাদের কাছে দুর্গোৎসব ঠিক যেভাবে জাঁকজমক করে পালিত হয়, জাপানবাসীর কাছে বেঞ্জাইতেনও কিন্তু সেই গুরুত্ব সহকারেই পূজিত হন। জানা যায়, জাপানে প্রায় একশোটিরও বেশি মন্দিরে বেঞ্জাইতেন দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। জাপানের সাগামি উপসাগরের এনোশিমমা দ্বীপ, বিওয়া হ্রদের কাথে চিকুন দ্বীপ, এবং সেতো অন্তর্দেশীয় সাগরের ইৎসুকুশিমা  দ্বীপের মন্দিরগুলিতে সাড়ম্বরে বেঞ্জাইতেন-এর আরাধনা করা হয়। তবে জাপানে সরস্বতী দেবীর পুজোয় কিন্তু মন্ত্র, পূজা-পাঠ, যাগ-যজ্ঞের প্রচলন রয়েছে। কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি মেনে রীতিমতো সংষ্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে হোম করে দেবীর আরাধনা করা হয়। জাপানি ভাষায় হোমকে গোমা বা হাভানা বলা হয়।

আর একটি অবাককরা তথ্য হল জাপানে একাধিক অঞ্চলে থাকা জলাশয়কেও বেঞ্জাইতেন নামকরণ করা হয়েছে। জাপানে এইসব জলাশয়ের মাঝখানে বা কোনও এক ধারে মন্দির থাকলেও তাতে কোনও দেবীমূর্তি থাকে না। বরং ওইসব জলাশয়কেই দেবী সরস্বতীরূপে পুজো করা হয়। আর অবাককরা বিষয় হল এটাই যে, আমাদের দেশেও কিন্তু সরস্বতী নদী ছিল। দেবী যে পদ্মের ওপর বিরাজ করেন এমনকী দেবীর বাহন হাঁসের সঙ্গেও জলের একটা নিবিড় যোগ রয়েছে।

কিন্তু কখনওকি ভেবে দেখেছেন যে, জাপান এবং ভারতের মধ্যে আপাত অর্থে সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকে এত পার্থক্য থাকার পরেও  সুদূর জাপানে দেবী সরস্বতীর প্রচলন ঘটল কীভাবে?…  এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে চলে যেতে হবে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় তেকে পঞ্চদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে। বর্তমানে যেখানে দক্ষিণ-মধ্য ভিয়েতনাম অবস্থিত একসময়ে সেখানে ছিল চম্পা রাজ্য। এই সময়ে প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চম্পা রাজ্যের হিন্দু রাজাদের বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। তাদের মাধ্যমেই হিন্দু ধর্ম পৌঁছে যায় জাপানে, আর তা বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারের আনেক আগেই! আর এভাবেই সরস্বতী ছাড়াও ইন্দ্র, ব্রহ্মা, গনেশ, লক্ষ্মী-সহ বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবীও জাপানে বৌদ্ধ দেব-দেবীরূপে পূজিত হচ্ছেন।  

তবে ঠিক যে কারণে বাগদেবীর আরাধনা করা হয় তা হল বিদ্যালাভ, বুদ্ধিলাভ এবং যশলাভের জন্য। কিন্তু সেদিক থেকে দেখতে গেলে এত বাগদেবী কিন্তু ভারতীয়দের ক্ষেত্রে একপ্রকার পক্ষপাতিত্বই করেছেন। অন্যদিকে জাপানিরাই কিন্তু দেবীর আশীর্বাদধন্য। কারণ সারা ভারতে সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশ অন্যদিকে জাপানে সাক্ষরতার হার ৯৯ শতাংশ। সুতরাং একটা কথা স্পষ্ট যে, সারা বছর ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষার আগে দেবীর আরাধনা না করে সারাবছর পরিশ্রম করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যার দেবীর আরাধনা করলেই তা ফলপ্রদ হয়। কি বলেন…