শুভজিৎ দে|

বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দি ছিলেন ননীবালাদেবী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার অন্তর্গত বালির এক সাধারন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। ১৮৯৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে  হয়েছিল, কিন্ত বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালেই তাঁর স্বামী মারা গেলেন। ননীবালা দেবীর বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। সে যুগে ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবাদের জীবন ছিল এক দুঃখের আবরণে মোড়া। সংসারের এক কোণায় জীবন্তমৃতের মত বেঁচে থাকাই ছিল তাদের জীবন। বিনা মাইনেতে শ্বশুর বাড়ি কিংবা বাপের বাড়িতে খেটে খেটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁচে থাকতে হত তাদের।

ননীবালা সে সব কথা মেনে জীবন কাটাতে রাজি হলেন না, কারণ স্বদেশীদের নানা খবর তিনি রাখতেন ও তিনি সামান্য লেখাপড়াও জানতেন।

সেসময় ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুবক, বৃদ্ধ সকলেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যে যেমনভাবে পারছে সাহায্য করছে বিপ্লবীদের। ওই সময় দেশের ডাকে সদ্য শহীদ হয়েছেন কিশোর ক্ষুদিরাম। এমতাবস্থায় ননীবালা স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী ছিলেন বিপ্লবী চরমপন্থী যুগান্তর পার্টির নেতা। তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন ননীবালাকে। শুরু হল জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী সমিতির এক নির্ভরযোগ্য সক্রিয় সহযোগী। দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিলেন। এমন দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো সম্পন্ন করা আরম্ভ করলেন যে, কাছের মানুষও টের পায়নি তিনি বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। তিনি বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, নেতাদের নির্দেশ ও অন্যান্য দরকারী খবরাখবর এবং সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র গোপনে বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। এমনকি জেলেবন্দি কর্মীদের সঙ্গে বাড়ির লোক সেজে দেখা করে, খবর সংগ্রহ করার কাজও তিনি করতেন।

সারাদিন তকলিতে সুতো কাটতেন, আর সুতো পৌঁছে দিতেন যারা পৈতা বানাতো তাদের কাছে। যা ছিলো তখনকার সাধারণ বাঙালি ঘরের আর পাঁচটা ভালো বিধবার জীবিকা। অন্ধকার নামলেই মানুষের চোখ এড়িয়ে, পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে তিনি দেশের কাজে বের হতেন। তাঁর সাধারণ জীবন যাপন দেখে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারত না বিপ্লবী বলে।

১৯১৫ সালে ঘটে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা, ভারত-জার্মান অস্ত্র ষড়যন্ত্র। ১০ সেপ্টেম্বর যুগান্তর পার্টি প্রধান বিপ্লবী বাঘা যতীন ‘কোপতিপোতায়’ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়ে বালাসোর হাসপাতালে মারা যান। কলকাতাতে পুলিশি ধরপাকড়ের সময় শ্রীঅমরেন্দ্র চ্যাটার্জী পালিয়ে গেছেন, ধরা পড়েছেন বিপ্লবী শ্রীরামচন্দ্র মজুমদার। তাঁর হাতে একটি মাউজার পিস্তল এসেছিল, কিন্তু তিনি সেটি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন কেউ তা জানত না। অথচ বিপ্লবীদের সেটির দরকার ছিল, কিন্তু কীভাবে তার সন্ধান জানা যাবে?

তখন জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের খোঁজ আনতে চললেন দুঃসাহসী ননীবালা। সেদিনের সমাজে যা কেউ কল্পনাও করতে পারত না।  বিধবা ননীবালা একগলা ঘোমটা দিয়ে, রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জেলে। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে, পিস্তলের সন্ধান জেনে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে। এরপর পুলিশের টিকটিকি লাগল তার পিছনে। বাসস্থান বদল করতে হল তাকে।

রিষড়া থেকে তিনি চলে এলেন চন্দননগরে। বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী সেখানে বেনামে বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন  ননীবালাকে আর নিজের পিসীমাকে। সেই বাড়িগুলোতে অনেক দিন নিরাপদে থেকে গেছেন বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী, জাদু গোপাল মুখোপাধ্যায়, বিনয় ভূষণ দত্ত, নলিনীকান্ত কর, অতুল ঘোষ প্রমুখ বাঘা বাঘা বিপ্লবীরা। যাঁদের নামে জারি ছিল অনেক টাকার হুলিয়া। এঁদের কাছ থেকে খবর বা অস্ত্র সংগ্রহ করে বাইরের বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন, আর বাইরে থেকে কিছু জোগাড় করতে হলে সেগুলি জোগাড় করে এনে এঁদেরকে পৌঁছে দিতেন বিপ্লবী ননীবালা। তিনি রাতের  অন্ধকারে নিশাচরের মতো হাজির হতেন, পুলিশের গন্ধ পেলেই অদৃশ্য হয়ে যেতেন।

১৯১৬ সালে পুলিশের নজর পড়ল বাড়ির কর্ত্রী ননীবালার ওপর। তাদের সব কাজের খবরই পেল পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তার করতে আসার খবর পেয়ে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেলেন কলকাতা ছেড়ে, অবশেষে তার খোঁজ মিলল পেশোয়ারে। গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তিনি কলেরায় আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থ শয্যাশায়ী ননীবালা গ্রেপ্তার হলেন বেআইনি অস্ত্র রাখা, বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগে।

 তাঁকে রাখা হয়েছিল কাশীর জেলে। নানা ভাবে অত্যাচার করেও বিপ্লবীদের বিষয়ে একটি কথাও বের করতে পারেননি কাশীর জেলের দুঁদে  বাঙালি অফিসার পুলিশ সুপার জিতেন ব্যানার্জি। যেমন তাঁর  গায়ে লঙ্কাবাটা লাগানো হয়েছিল জেলের জমাদারনীকে দিয়ে। অসহ্য জ্বালা সহ্য করলেও মুখ খোলেননি তিনি। তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে সুপার জেলের প্রাচীরের বাইরের দিকে, স্যাঁতস্যাঁতে আলো-বাতাসহীন অন্ধকার আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে একাকী আটকে রেখা হয় দিনের পর দিন। প্রতিদিন সেই সেলে একলা আটকে রাখার সময় বাড়ে অল্প অল্প করে। একদিন সেই আলো-বাতাসহীন সেলে ৪৫ মিনিট আটকে রাখার পর তাকে অচৈতন্য অবস্থায় বের করে আনার পরেও তার মুখ থেকে একটি কথা বের করা যায়নি। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতা আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। আলিপুর জেলে তাঁর ওপর লাগাতার  পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন শুরু করলেন ননীবালা। টানা ২১ দিন অনশনের পর, প্রতিদিনের মতো সেদিনও তাকে জেরা করার জন্য সেল থেকে গোয়েন্দা অফিসে আনা হয়েছিল। সাহেব তাকে বারবার অনশন তুলে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, “অনুষ্ঠান তুলে নিতে পারি, একটি শর্তে! আমাকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিনী শ্রীসারদা মার কাছে রেখে আসতে হবে!”

সাহেব বললেন চিঠিতে লিখে দিতে। কাগজ কলম দেওয়া হল তিনি চিঠি লিখলেন। চিঠি হাতে নিয়ে মুচকি হেসে সাহেব চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে। অপমানের ফল  মিলল হাতে হাতে, সাহেবের গালে পড়ল সপাটে এক চড়। দ্বিতীয় চড়টি গোয়েন্দা অফিসার মিস্টার গোল্ডির সাহেবের গালে পড়ার আগেই তাঁর হাত চেপে ধরেছেন অফিসের অন্য কর্মীরা। হাত চেপে ধরা অবস্থাতেই বাঘিনীর মতো গর্জে চলেছেন ননীবালা। বললেন, “এতো বড় স্পর্ধা তোমাদের? আমাদের দেশের মানুষ পরাধীন বলে কি কোনো মান-সম্মান নেই? চিঠিটা যদি ছিঁড়েই ফেলবে তবে লিখতে বলেছিলে কেন?” অনশনের ২১দিন পরেও এই স্পর্ধা, মনবল আর তেজ দেখে সবাই বিস্মিত।

১৮১৮ সালে রাজবন্দি হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে চালান হলেন তিনি। ননীবালা দেবী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার প্রথম রাজবন্দি। ১৯১৬ সালে ধরা পড়ার পর থেকে  ১৯১৯ পর্যন্ত প্রায় চার বছরের মাথায় মুক্তি পেলেন তিনি। অসুস্থ ননীবালার তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুও ছিল না। কোনো পূর্ব পরিচিতের অনুগ্রহে তিনি একটি কুঁড়ে ঘর ভাড়া পেলেন হুগলিতে। সুতো কেটে, রান্নার কাজ করে কোনমতে তাঁর দিন কাটতে থাকে। কেউ সে সময় তাঁর খবরও নেয়নি। অবশেষে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৬৭ সালে। কেউ মনেও রাখেনি তাঁর সেই আত্মত্যাগের কথা।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

ছবিঃ লিটেরেট প্যারাডাইস এবং উইকিপিডিয়া