কাঁধের ওপর জ্যাভলিনটা নিয়ে দৌড় শুরু। আস্তে আস্তে গতি বাড়তে থাকে। মাথাটা প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রীতে আকাশের দিকে। বামহাত আর জ্যাভিলিনটা মাথার সঙ্গে সমান্তরাল করে শরীরটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে, যেমন করে ক্রিকেটে বল করে খানিকটা সেই ভঙ্গিমায় সর্বশক্তি দিয়ে জ্যাভিলিনটা ছুড়ে দেয় আকাশে। যেন একটা মিসাইল। লক্ষ্য স্থির, সেই হলদে ধাতুটার ছুঁচোলো মাথাটা হু হু করে উপরে উঠতে থাকে। আস্তে আস্তে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল আর তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা নীচের দিকে নামতে নামতে যখন মাটিতে স্পর্শ করে সম্পূর্ণ করল এক স্বপ্নের অধিবৃত্তীয় পথ, তখন নীরজ যেন ছুঁল আকাশকে। জ্যাভলিনের সেই উড়ানটা যেন – কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, যেন গুজরাত থেকে অরুনাচল, যেন একশো চল্লিশ কোটি মানুষের স্বপ্নের উড়ান। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে দেশের হয়ে প্রথম সোনাটা এল পানিপথের অখ্যাত গ্রাম খান্দ্রা থেকে উঠে আসা নীরজের হাত ধরে। তবে তাঁর উত্থানটা মোটেও সহজ ছিল না। হরিয়ানার এক চাষির ঘরে জন্ম নীরজের। ছোটবেলায় মহিষের লেজ মুলে বা পটকা ফাটিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের উত্যক্ত করে মারত ছোট্ট ছেলেটা। তখন কে-ই বা জানত একশো চল্লিশ কোটির স্বপ্ন পূরণ করবে সে।

নেহাত শরীর চর্চার জন্যে ষোল-সতেরো কিলোমিটার দূরে পানিপথ স্টেডিয়ামে যেত ছেলেটা। সেখানে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় জয়ভীরের সঙ্গে। তাঁকে জ্যাভলিন ছুড়তে দেখেই জ্যাভিলিনের প্রতি ভালোলাগা, তা থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকে স্বপ্ন দেখা। প্রথম আন্তর্জাতিক মেডেল ২০১৬ সালে সাউথ এশিয়ান গেমস-এ। সেই থেকেই শুরু। তারপর তাঁর জ্যাভলিন উড়তে থাকে। ২০১৭ সালে এশিয়ান গেমস-এ সোনা, ২০১৮ সালে কমনওয়েলথ গেমস-এ সোনা এবং অবশেষে ৭ আগস্ট, ২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিক ২০২০-তে বিশ্বজয়ের ইতিহাস রচনা। এ যেন এক মহাকাব্যিক পথ, অনেক লড়াইয়ের শেষে যেন যুদ্ধ জয়ের বীরগাথা৷ দু’হাত উপরে তুলে সগর্বে ঘোষনা যেন আমরাও পারি৷ অবশেষে একশো বছরেরও বেশি দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান৷ বিশ্বমঞ্চে – ‘জনগণমন অধিনায়ক….’, তুমিই আজ অধিনায়ক সমগ্র দেশবাসীর, তুমিই আজ অধিনায়ক সমগ্র জাতির৷

যে রাজ্য মূলত কুস্তি বা হকির জন্যে বিখ্যাত, যে দেশ খেলা বলতে ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, সেখানে জ্যাভলিনে ভালোবাসা জন্মানোই একটা খুব বড় ব্যাপার। ক্রিকেট ইনফ্রাস্ট্রাকচার দেশে বেশ কিছু আছে, হকিতেও কিছুটা হলেও আছে। তাই বলে জ্যাভিলিন! সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে অলিম্পিকে জ্যাভিলিনে নীরজের সোনার পদক যেন এক পায়ে এভারেস্ট জয়ের চেয়েও অনেক বেশি। সত্যি অবাক হতাম না যদি ছেলেদের হকি টিম সোনা জিতত, কারণ আটবার আমরা অলিম্পিকে সোনা জিতেছি, একটা পরম্পরা আছে। আমাদের সৌভাগ্য নীরাজের বাবা-মা ওকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে বলেননি, আমাদের সৌভাগ্য নীরজ ক্রিকেটের গ্ল্যামার ছেড়ে বেছে নিয়েছিল জ্যাভলিন।

আজ আমরা যারা সবাই এই আনন্দে গা ভাসাচ্ছি, তারাই কি ক্রিকেটার ছাড়া আর কোনও খেলোয়াড়কে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিই? ক্রিকেটকে ছোট না করে বলছি, পৃথিবীতে ক’টা দেশই বা ক্রিকেটটা খেলে? ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ফুটবলে বিশ্বকাপ জিতলে কলকাতায় বিজয় মিছিল হয়, ভাবটা এমন যেন আমরাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেখানে একটা স্বর্ণপদক দিয়ে নীরজকে মাপাটা বোধহয় ভুল হবে যেখানে অলিম্পিকের ইতিহাসে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে দেশে প্রথম সোনা। তাই শুধু একশো চল্লিশ কোটি বললে ভুল হবে, গত একশো পঁচিশ বছরের প্রতিটি ভারতবাসীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে নীরজ। আমরা যদি কাউকে ক্রিকেটে ঈশ্বর বানাতে পারি, তাহলে তো নীরজকে ঈশ্বরোত্তর কোনও উপাধিতে ভূষিত করতে হয়। কাল পর্যন্ত যাকে কেউ সেইভাবে চিনত না আজ হয়তো তার নামটা সবাই প্রথমবারের জন্যে হলেও শুনল। বছর পাঁচেক পরেও যদি সেই মুখটা আমাদের কারও মনের মধ্যে থেকে যায় তাহলে বলব যাক কিছুটা সম্মান আমরা বাকিদেরও দিতে পেরেছি। না হলে হয়তো আরও একশো বছর অপেক্ষা করতে হবে আরও একটা নীরজের জন্যে। সাবাস নীরজ! ক্রীড়া-বিমুখ এক জাতিকে বিশ্বের দরবারে সম্মান এনে দেওয়ার জন্যে। এই বিশ্বজয় আমাদের সবাইকে নতুন করে অনুপ্রাণিত করুক এই আশা রেখেই লেখাটা শেষ করলাম। জয় হিন্দ!

ছবিঃ গেটি ইমেজেস