আজ ১২ জানুয়ারি। স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী আজ। ভগিনী নিবেদিতার একটি অন্যতম উক্তির মধ্যে দিয়েই এই মহান দার্শনিক ও প্রকৃত সন্ন্যাসীর পুনর্বার উপলব্ধি করা যাক। স্বামীজীর পরম প্রিয় শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাকে একবার রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মধ্যে তফাৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন― ‘‘অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে, তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ। আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে, তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।’
কথাটি যে চরম সত্য, তা আমরা 2022 সালে দাঁড়িয়ে আজও সর্বতোভাবে উপলব্ধি করি। অনৈতিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ধর্মান্ধ আত্মবিস্মৃত কোনও সমাজকে বিবেকানন্দ আজও পথ প্রদর্শন করে চলেছেন। তাঁর মতাদর্শ ও জীবনদর্শন আজও চলার পথার প্রেরণা।
কালের নিয়মে আমরা এগিয়ে চলেছি। বিশ্বযুদ্ধ দর্শনের সুযোগ না হোক, দোরগোড়ায় মহামারীকে স্বাগত জানিয়েছি। হাতের মধ্যে গোটা বিশ্বের নাড়ি-নক্ষত্র বন্দি করেছি আমরা। হতে পারে আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি আরও আধুনিক জীবন, কিন্তু তাদের ভালোথাকার রসদ কি ওই দিয়ে পূর্ণ হবে? সম্ভবত না। খবর খুললেই যে তরুণ প্রজন্মের বিপথে যাওয়ার কোনও না কোনও চিত্র সামনে উঠে আসে রোজই, তা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। বর্তমান প্রজন্ম তাৎক্ষণিক সুখের সন্ধানে উদ্যমহীন, নিষ্ঠাহীন, নীতিহীন বোহেমিয়ান যে জীবনে ব্যাপৃত, তা মানব সমাজের অবক্ষয়কে তরান্বিত করছে। কিন্তু ‘সুখ যে আত্মতৃপ্তিতে নেই, আছে আত্মব্যাপ্তিতে’-স্বামীজীর এই মূল জীবনদর্শনকে বর্তমান সমাজের জন্য পুনরায় ব্যক্ত করা প্রয়োজন। স্বামীজী যে ‘নরের মধ্যে’ নারায়ণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন; দরিদ্র ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলে সম্বোধন করে ছিলেন – তা বর্তমান সমাজ বিশেষত যুব সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছে।
‘বর্ণে বর্ণে নাহিক বিশেষ, নিখিল ভুবন ব্রহ্মময়’ অর্থাৎ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নয় বরং সমস্ত মানব আত্মার মধ্যে সাম্য সাধনই পরম ব্রহ্মময় তথা ঈশ্বর– স্বামীজীর এই পরম উপলব্ধিকে বর্তমান সমাজের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদে বিশ্বাসী মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তবেই ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’কথাটি ফলপ্রসূ হবে।
এই মহান ব্যক্তির জীবনদর্শন আজ সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে যুব সমাজের কাছে। শুধুমাত্র যুবসমাজ নয়, নৈতিকতার আবরণে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়োজনে গোটা সমাজ ব্যবস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সবক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে স্বামীজীর মতাদর্শকে পুনর্বার সকল মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার।
আজ এই মহান মানুষের জন্মদিবসে স্মরণ করি তাঁর মহা মূল্যবান বাণী– পরোপকারই জীবন, পরহিত চেষ্টার অভাবই মৃত্যু। শতকরা নব্বই জন নরপশুই মৃত, প্রেততুল্য; কারণ হে যুবকবৃন্দ, যাহার হৃদয়ে প্রেম নাই, সে মৃত ছাড়া আর কি? হে যুবকবৃন্দ, দরিদ্র অজ্ঞ ও নিপীড়িত জনগণের ব্যথা তোমরা প্রাণে প্রাণে অনুভব কর, সেই অনুভবের বেদনায় তোমাদের হৃদয়ে রুদ্ধ হউক, মস্তিষ্ক ঘুরিতে থাকুক, তোমাদের পাগল হইয়া যাইবার উপক্রম হউক। তখন গিয়া ভগবানের পাদপদ্মে তোমাদের অন্তরের বেদনা জানাও। তবেই তাহার নিকট হইতে শক্তিও সাহায্য আসিবে-অদম্য উৎসাহ, অনন্ত শক্তি আসিবে।
শুরুতেই উক্ত ভগিনী নিবেদিতার কথা স্মরণ করেই বলি, অনন্ত অসীম জ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ শুধুমাত্র আগামী দেড় হাজার বছরের নয়, যুগে যুগে তিনি মানব সমাজের অগ্রিম প্রতিনিধি ও ভবিষ্যত পথ প্রদর্শক।