শুভজিৎ দে|

বাংলার ষষ্ঠতম রাজধানী কলকাতা। এই শহর কখনও ‘তিলোত্তমা’, ‘প্রাসাদনগরী’ কখনও বা ‘City of JOY’ এমন নানা অভিধায় ভূষিত হয়ে থাকে। বর্তমান কলকাতা জব চার্নকের আমলের শিয়ালদহে ঐতিহাসিক বৈঠকখানায় গাছতলায় বসে হুঁকো খাওয়ার কলিকাতা আর নেই। এখনকার কলকাতায় বহু রাস্তা এবং গলি জন্মছে, সেই সব রাস্তার নামের সঙ্গে আবার জুড়ে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস এবং কিছু প্রচলিত গল্প। গল্প কেন বললাম, তার কারণ – অনেক ঘটনার ঐতিহাসিক সত্যতা এখনও পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি, তাই গল্প বলাই শ্রেয়। যাই হোক, তেমনই কিছু রাস্তা আমার এই লেখনী পর্বের বিষয়। আজ যে রাস্তা নিয়ে আলোচনা করছি তা হয়তো অনেকেরই জানা, যাদের পোষ্য বা বাহারি ফুল, গাছ দিয়ে বাড়ি সাজাবার নেশা আছে তারা একবার এখানে গেছেন নিশ্চয়ই। আর এই প্রাচীন এবং জনপ্রিয় রাস্তাটি হল গ্যালিফ স্ট্রিট।

‘গ্যালিফ স্ট্রিট’ এই রাস্তাটি পশ্চিম দিকের পেরিন পয়েন্ট (বর্তমানে গঙ্গার ওপরে চিৎপুরের ঝুলন্ত ব্রিজ) থেকে শ্যামবাজার ব্রিজ (যেটাকে এখন দমদম ব্রিজ বলা হয়) এবং পূবে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ক্রসিং পর্যন্ত বিস্তৃত। বাগবাজার খাল বরাবর চলেছে এই রাস্তাটি। এই খালটি ১৮২৪ সালে খনন করা হয়। স্যার গ্যালিফ ছিলেন কলকাতার কালেক্টর ও কমিশনার এবং খালটির পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে এই প্রাচীন রাস্তাটি।

তখন সময়টা ১৭৫৬, যখন নবাব সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন। তাঁর সেনাপতি মীরজাফর বরানগর, কাশীপুর, চিৎপুর এবং টালায় তাবু খাটিয়ে কলকাতার গভর্নর হলওয়েল-এর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। হলওয়েল সাহেবও তাঁর সৈন্যদলকে নিয়ে বাগবাজারের দিকে প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। যুদ্ধে মীরজাফর পরাজিত হন এবং দমদমের ফিরে যান। তিনি ফিরে যাওয়ার সময় চার-পাঁচটি বন্দুক ফেলে যান, কিন্তু কেন তা জানা যায় না। বন্দুকগুলি বাগবাজারে খালের দক্ষিণ দিকে গ্যালিফ স্ট্রিটের মাটিতে নীচে পুঁতে রাখা হয়। এগুলি পরে আর উদ্ধার হয়নি।

পরবর্তীকালে গ্যালিফ স্ট্রিট এবং আর.জি. কর রোডের সংযোগস্থলে নতুন দমদম ব্রিজের নীচে যখন বাগবাজার খালের মাটি খোঁড়া শুরু হয়, তখন সেখান থেকে দুটি বড় বন্দুক পাওয়া যায়। একটি ছিল দৈর্ঘ্যে ৯ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং অন্যটি ৮ ফুট ৯ ইঞ্চি। প্রথমটির মাজেল ছিল ৪ ইঞ্চি এবং দ্বিতীয়টিরও ৪ ইঞ্চির। কিন্তু এই বন্দুকগুলি কাদের – ইংরেজদের না নবাবের তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। এই নিয়ে লোকমুখে নানা গল্প প্রচলিত আছে।

এ তো গেল ইতিহাস, তবে এছাড়াও গ্যালিফ স্ট্রিট অন্য ভাবেও পরিচিত এই শহরের শৌখিন মানুষজনের কাছে,
স্থান সংকুলানের অভাবে হাতিবাগানের সেই বিখ্যাত ‘পাখির হাট’ একসময় উঠে এসেছিল বাগবাজার সংলগ্ন এই গ্যালিফ স্ট্রিটে। সে প্রায় আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। জায়গা বদলেছে, বদলেছেন মানুষজনও; কিন্তু ‘পাখির হাট’ তার ভোল বদলে ফেলেনি। আজও একইরকম ঐতিহ্য বহন করে এগিয়ে চলেছে বেচা-কেনা, দরদাম, কখনও জমাটি আড্ডা, আবার কখনও বা চিরকালীন বন্ধুত্ব। এখানে গেলে দেখতে পাবেন নানা রকমের খড়গোশ, কুকুর, বিড়াল, পাখি, মাছ, বাহারি ফুল এবং বিভিন্ন প্রজাতির বানসাই গাছের হাট। তবে আপনি যদি পোষ্য সম্পর্কে সমঝদারদের দলে না পড়েন তবে আপনি ঠোকেও যেতে পারেন, রবিবার করে বসে এই মার্কেট, লকডাউন শেষে একবার ঢু মারতেই পারেন। কোনও পোষ্য কিনুন বা নাই কিনুন, দেখতে কিন্তু তাদের চমৎকার লাগে।

ছবি: শুভজিৎ দে