নিঝুম শীতের রাত। বরফের চাদরে মোড়া চারপাশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোটা কয়েক বাড়ি। যার ছাদের চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোনো কমে এসেছে। ফায়ার প্লেসের আগুন প্রায় নিভু নিভু। কুয়াশায় মাখা জানলার শার্সির ওপারে শুধুই অন্ধকার। ঠিক সেই ফাঁকে আকাশ থেকে একটা স্লেজ গাড়ি এসে থামে ছাদের কিনারে। সেখান থেকে নিঃশব্দে লাফিয়ে নামেন এক নাদুসনুদুস বৃদ্ধ। লাল উলের সোয়েটারে আর টুপিতে দারুণ দেখায় তাকে। পেল্লায় সাদা দাড়ি সামলে তিনি কাঁধে তুলে নেন মস্ত ঝোলা। সেই ঝোলা রঙ বেরঙের বাক্সয় ঠাসাঠাসি। এর পর বাড়ির অন্দরে নেমে আসেন চিমনি পথ বেয়ে। আর সকলের অগোচরে রেখে যান রাশি রাশি উপহার।

রূপকথার সান্তা ক্লজ (Santa Claus) তো এমনই। কল্পনায় যার অবাধ গতিবিধি। স্লেজ গাড়ি চেপে কখনও নরওয়ে তো কখনও ধনেখালিতেও পৌঁছে যেতে পারেন তিনি। এই সান্তার জন্ম কিন্তু লোকগাথায়। সঠিক সময়কাল নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও আনুমানিক ১৬০০ বছর আগে এই সান্তার আবির্ভাব। পাশ্চাত্যের রূপকথায় এক স্বপ্নের চরিত্র ইনি। তবে তার কিসসা কিন্তু সবটা মনগড়া নয়। বাস্তবেও সান্তা ছিলেন আর তার দেখানো পথেই আধুনিক সান্তার জনপ্রিয়তা এত। যীশু খ্রিষ্টের মৃত্যুর আড়াইশো বছর পরেই জন্ম হয়েছিল আসল সান্তা ক্লজ-এর।

ইতিহাসের পাতায় তার নাম সেন্ট নিকোলাস (Saint Nicholas) । ওলন্দাজ ভাষায় সেন্ট নিকোলাসকে ডাকা হত Sinterklaas বলে। সেখান থেকেই সান্তা ক্লজ। তিন শতকে নিকোলাসের জন্ম হয় আধুনিক তুরস্কের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ‘পাতারা’ গ্রামে। সম্ভবত তিনি ছিলেন মায়রার বিশপ। তার বাবা ছিলেন অগাধ সম্পত্তির অধিকারী। শোনা যায়, খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান নিকোলাস। তখন তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে কীভাবে এই বিপুল সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার করা যায়। এবং সেখান থেকেই ‘সান্তা’ হওয়ার যাত্রা শুরু। ছিপছিপে লম্বা চেহারার নিকোলাস দেখলেন দেশে প্লেগের মতো মড়ক লেগেছে। মানুষ অনাহারে মরছে, অসুখে মরছে। বাবার সম্পত্তি অকাতরে বিলোতে শুরু করেন তিনি। প্রচলিত রয়েছে, এই দান-এর কর্মটি তিনি সারতেন খুব সন্তর্পণে এবং সকলের অগোচরে। কেউ অভাবে রয়েছে জানতে পারলেই গভীর রাতে তার বাড়িতে সাহায্য নিয়ে হাজির হতেন নিকোলাস। কাউকে না জানিয়েই রেখে আসতেন অনেক জিনিস। ক্রমে বিপদাপন্ন মানুষের সন্ধানে এক দেশ থেকে অন্য দেশ চষে বেড়ানো নেশায় পরিণত হল। শিশুদের প্রতি তাঁর অগাধ স্নেহ ও ভালবাসার কথাও শোনা যায়। ছোটদের কাছের মানুষ ছিলেন নিকোলাস। ধীরে ধীরে সারা ইউরোপে পরোপকারী হিসেবে নিকোলাসের পরিচিতি বাড়তে থাকে। মানুষ মনে করত, সাক্ষাৎ যীশু-ই পাঠিয়েছেন তাঁকে। এর কিছুদিন পর নিকোলাস বিশপ নির্বাচিত হন। তখন থেকেই এক শ্রেণীর মানুষের রোষের মুখে পড়েন তিনি। তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। সেকালের সম্রাট কন্সট্যান্টাইন (King Constantine) ক্ষমতায় আসার পর অবশ্য তিনি মুক্তিও পেয়েছিলেন।

৩৪৩ খ্রীস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যু হয়েছিল নিকোলাসের। মৃত্যুর পর তাঁকে স্মরণ করার জন্য ডিসেম্বরের ৬ তারিখ দিনটিই জনপ্রিয় হতে থাকে ধীরে ধীরে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিকোলাস-এর কাজ মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে তাঁর মৃত্যুর পরেও। ৬ ডিসেম্বর নিয়ে মানুষ এতই মেতে ওঠেন, ২৫ ডিসেম্বরের গুরুত্ব তুলনামূলক ফিকে লাগে। ঠিক এই বিষয়টাই ভালো চোখে নেন না তৎকালীন গোঁড়া খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচারকরা। তাঁরা বিকল্প রাস্তা বের করেন অনেক ভেবে। খ্রিষ্টের অন্যতম সেরা সন্তান সেন্ট নিকোলাসের কাজ স্মরণ করার জন্যে ২৫ ডিসেম্বর দিনটিকেই ধার্য করেন তারা। খুব স্বাভাবিক কারণেই এতে আপত্তির কিছু ছিল না। ফলত যীশুর জন্ম দিবসই (Christmas Day) নিকোলাসকে উৎসর্গ করার রেওয়াজ চালু হয় এবং এই দিনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই বিশেষ দিনে নিকোলাসকে স্মরণ করে বহু মানুষ শিশুদের হাতে উপহার আর অভাবীদের কাছে সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যেত। তাঁর পরোপকার আর মানবসেবার কাহিনি এভাবেই জন্ম দেয় সান্তা ক্লজ-এর। সেই লোকগাথায় কালের পরত জমতে জমতে কখন যে ছিপছিপে লম্বা নিকোলাস নাদুসনুদুস রূপকথার চরিত্রে বদলে গেল, তা নিয়ে গবেষণা অব্যাহত। সম্ভবত সান্তার বাহন হিসেবে স্লেজ গাড়িও এসেছে অনেক পরে। এখনও অনেক দেশেই ‘সান্তা ডে’ হিসেবে ৬ ডিসেম্বরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ২৫ ডিসেম্বরই জনপ্রিয়। সময়ের দলিলে জমা হোক আরও অনেক নতুন তথ্য। ছিপছিপে নিকোলাস না নাদুসনুদুস সান্তা কার পাল্লা ভারী, সে গবেষণাও চলতে থাকুক। আমরা বরং এটুকুই চাইতে পারি, লক্ষ শিশুর অন্তরে যেন বেঁচে থাকে আদর আর ভালোবাসার স্বপ্ন।