তাথৈ-এর স্কুল থেকে বেরিয়ে, সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছিল দেবদত্তের। আজ প্রায় ৯ বছর পর পারমিতার সাথে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা। বুকের ভিতর যেন একটা ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়েছে! কখনও হাজারটা প্রশ্ন করবার ইচ্ছা, কখনও মনে পুষে রাখা জীবন্ত সব স্মৃতিদের ওঠানামা, সব কিছু একসাথে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। এত সময় চলে গেছে, এতকিছু পাল্টে গেছে; তা সত্ত্বেও আজকের এই দেখা হওয়ার মধ্যেও কোথায় যেন সেই পুরোনো আবেগে ভরে উঠেছে মন। এই সেই পারমিতা, যাকে না দেখে, যার সাথে কথা না বলে, একসময় একটা মুহুর্তও কাটাতে পারত না সে, আর আজ তাকে একঝলকে দেখে যেন চেনাই যায় না। কেবলি মনে হয় সেই অবিকল হাসি, সেই অবিকল কথা বলার ধরণ আর ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গীমার অন্য কেউ। তার মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না, পারমিতার সাথে এতদিনের পর আজকের এই আবার দেখা। কোনও এক বিস্ময়ের দোলাচলে শিহরিত হচ্ছে সে।  

কলেজ ক্যান্টিনে তাদের সেই ‘প্রথম দেখা’র কথাটা মনে পড়ে গেল দেবদত্তের—

“ফার্স্ট ইয়ার?” প্রথম কথা; পারমিতাই বলেছিল।

“হ্যাঁ, তোমার?”

“আমারও ফার্স্ট ইয়ার; হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট! তুমি?”

“আমার জুলজি।”

“আমি পারমিতা রায়…”

“দেবদত্ত চ্যাটার্জী। চা খাবে?”

“ওই জিনিসটাতে আমার নো আপত্তি! সব সময় খেতে পারি; এখন যদিও একটা শর্ত আছে…”

“কী শর্ত?”

“তুমি যদি আমার থেকে টোস্ট নাও, তবেই একসাথে চা খেতে পারি।”

খুব অল্প সময়েই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তাদের, পারমিতাকে অবাক চোখে দেখছিল সে, কেমন চঞ্চল তার দৃষ্টি, কী মিষ্টি স্নিগ্ধতা তার কথা বলায়, আর কানের পাশের ওই চুলটা…

কলেজ এসে এতজনের সাথে তো আলাপ হল তবু এই মেয়েটার সাথে কথা বলে, এতদিনে যেন একটা বন্ধু পেল সে।

ফোন নম্বর চাইবার শক্ত কাজটাও করে দিয়েছিল পারমিতাই। তারপর কখন যে, কলেজ ক্যান্টিনে দেখা হওয়া অচেনা দু’জন একে অপরের জন্য অনেকখানি হয়ে উঠল, সে খেয়াল তাদের কারোরই ছিল না। কলকাতা থেকে দূরে ছোট্ট একটা মফস্বলে বাবা, মা, বোন, ঠাম্মি সবাইকে নিয়ে একসাথে বেড়ে ওঠা ছেলেটার, বাড়ির বাইরে থাকার কষ্ট, লুকিয়ে রাখা মনকেমন, সব কিছুকে কাটিয়ে উঠে, শহরের মায়ায় আটকে পড়ার কারণ হয়েছিল—পারমিতা। তারপর, যখন হাতে হাত রেখে কলকাতা দেখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই প্রাচীন তিলোত্তমাকে সাক্ষী রেখে বারবার পারমিতার প্রেমে পড়েছে দেবদত্ত; তখনই গোধূলির আলোয় রাঙিয়ে ওঠা গঙ্গার মতোই বসন্ত আভা ছড়িয়ে পড়েছিল পারমিতার হৃদয়েও। চোখ বুঝলে আজও সেই রাতজাগা গল্প আর জমিয়ে রাখা কবিতার দিনগুলো, এই কালকের কথা মনে হয়।

“বাবাই, বাবাই!” মেয়ের ডাকে চমক ভাঙল দেবদত্তের।

তাথৈকে সামনে বসিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দিল সে।

“বাবাই! দেখলে আমার পারমিতা মিস-কে, শি ইজ মাই ফেভারিট টিচার!”

“আচ্ছা তাই বুঝি!”

“জানো তো বাবাই, তোমায় না… একটা সারপ্রাইজ… বাবাই, বাবাই! আইসক্রিম খাব, তুমি বলেছিলে ফেরার সময়…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই… চলো চলো!”

দেবদত্ত কলকাতার একটা কলেজে পড়ায়, আর তার মেয়ে তাথৈ, দাদু-ঠাম্মার কাছে থাকে, তাদের মফস্বলের বাড়িতে। মেয়ের আবদার ছিল—আজ বাবাই এর সাথেই রেজাল্ট আনতে যাবে, তাই কাল তাকে বাড়ি আসতেই হয়েছে।

“এই তো, দিদিভাই, তুমি এসে গেছ; বলো বলো, কেমন রেজাল্ট হল?” নাতনিকে দেখেই হাসিমুখে বললেন বিভাষবাবু।

“জানো তো দাদান, আমি সেকেন্ড হয়েছি! আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নাসিফ—ফার্স্ট!”

তারপরেই দাদু ঠাম্মাকে রেজাল্ট দেখিয়ে ক্লাস ওয়ানে সেকেন্ড হবার মাহাত্ম্য প্রচার করতে লাগল তাথৈ। আর হ্যাঁ, পারমিতা মিসের গুণকীর্তন তো কিছুতেই শেষ হচ্ছে না তার!

দুপুরের খাওয়া শেষ করে, পড়ার ঘরে একলা বসে কিছুটা সময় কাটাচ্ছিল দেবদত্ত। আজ কিছুতেই মন থেকে পারমিতা আর ফেলে আসা সেসব দিনের কথাগুলো সরাতে পারছিল না সে।

তখন সবে তাদের মাস্টার্সের প্রবেশিকা শেষ হয়েছে, দেবদত্ত বাড়ি আসার আগে দেখা করতে গেছিল পারমিতার সাথে। সেদিন পারো-র যন্ত্রচালিতের মতো বলে যাওয়া কথার প্রতিটা শব্দ, আজও যেন কানে বাজে তার;

“বাড়ির লোক আমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছে, কী করব বুঝতে পারছি না! মাকে তোমার কথা বলে দিয়েছি, মা বলেছে আর যেন কখনও এসব নিয়ে না-ভাবি, তোমার নাম মুখেও না-আনি। কোনোরকমে বন্ধুদের সাথে দেখা করার কথা বলে আজ বেরিয়েছি। তুমি আমাকে ভুলে যেও… ‘দেব-পারো’দের গল্পগুলো এমনই হয়, তুমি বলেছিলে না, পাল্টে দেবে? পারবে না! কারণ শরৎবাবু স্বয়ং যে আমাদের আলাদা করে গেছেন।”

নিজেকে কেমন দিশেহারা লাগছিল দেবদত্তের—কী বলবে, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না, শুধু মনে আছে পারোকে ধরে পাশের বেঞ্চটাতে বসিয়েছিল সে; তারপর কোথা থেকে যে কী হল… সেদিনের পর, বারবার ফোন করেও পারোর সাথে কোনও যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি। ডিপার্টমেন্ট আলাদা বলে কখনও কোনও কমন বন্ধুও ছিল না তাদের।

এরপর মাস্টার্স শেষ করে রিসার্চে ঢোকা, তারপর চাকরি পাওয়া সবই কেমন একটা হিসেবি নিয়মে চলছিল। বছর ছয়েক আগের একটা সন্ধ্যের কথা খুব মনে পড়ে, তখন তার পিএইচডি দ্বিতীয় বছর চলছে। ইনস্টিটিউট হোস্টেলের পিছনের বাগানের মতো জায়গাটা থেকে অন্যরকম একটা আওয়াজ শুনে দেখতে গেছিল সে, টর্চের আলোয় দেখে, একটা পুরোনো লালচে রং চটে যাওয়া কাপড়ে মুড়িয়ে কী জেনো রাখা আছে; প্রথমে কাছে যাবে না ভেবেও কীসের টানে যেন সব ভুলে কাছে গিয়েছিল, তারপর দেখে, একটা ফুটফুটে বাচ্চা… সাথে সাথেই তাকে কোলে তুলে নেয়, তারপরে তো কত কাণ্ড… আর আজ সেই মেয়ে ‘বাবাই’ বলে না ডাকলে বুকটাই খালি লাগে।

“বাবাই, বাবাই! ঠাম্মি তোমায় নীচে ডাকছে। এসো, এসো… এসো-না!”

মেয়ের ডাকে চমক ভাঙল দেবদত্তের। তাথৈ হাত ধরে রীতিমতো টানতে টানতে তাকে বসার ঘরে নিয়ে এল। ঘরে এসে, মায়ের সাথে পারমিতাকে জমিয়ে গল্প করতে দেখে অবাক দেবদত্ত;

“কী চমকে গেলে তো?” বলল পারোমিতা।

“তা ব্যাপারটা কী? মা বলছেন, তুমি নাকি ব্রহ্মচর্য নিয়েছ! বিয়ে করবার শখ তো তোমার সেই কবে থেকে, তাহলে!”

“তুমি এখন এখানে, মানে আমি তো…”

“উফফ তুমি তো দেখছি, এখনও তেমন হাবাগোবাই রয়ে গেছ…”

“দেখলি তো খোকা, তুই যে মেয়েকে ধরে আনতে পারলি না, আমি তাকে কেমন বেঁধে আনলুম…” বলল দেবদত্তের মা—অনুপমা দেবী।

“কিন্তু মা, ব্যাপারটা কী, আমায় কি একটু খুলে বলবে? তুমি পারোকে চিনলে কী করে? আর তোমাদের মধ্যে আলাপ… মানে আমি তো কিছুই—”

“আরে বাবা, এত প্রশ্ন একসাথে কেন করিস বল তো! এই গত মাসেই, ও তাথৈদের স্কুলে এসেছে, সেখানেই আলাপ, একদিন ধরে আনলুম সাথে করে, সেদিন দেওয়ালে আমাদের ছবি দেখে আমায় বলছে, ‘আপনি দেবদত্তের মা?’ তারপর তো আর তোর কথা ছাড়া কিছুই শুনতেই চায় না—তুই কী করছিস কোথায় থাকছিস, তাথৈ এর মা’য়ের খবর নেওয়া, সবকিছু এত আকুলভাবে জানতে চাইছিল। আর সেসময় যেভাবে ওর চোখমুখের পরিবর্তন… ফাঁকি দেবার চেষ্টা যদিও করেছিল, তবু মায়ের চোখ তো! তারপর ওর থেকে সবটা শুনে, তাথৈকে দিয়ে ঝোঁকটা ধরালাম তোকে আনবার জন্যে…” এতটা বলে থামলেন অনুপমা দেবী।

“এতসব হয়েছে আর আমায় তুমি কিচ্ছুটি বললে না?” বলল দেবদত্ত।

“শোন বাবা, জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না, তোরা যখন সেই সুযোগ পেয়েছিস তখন তা হারাস না… তোদের অসম্পূর্ণতাকে এবার সম্পূর্ণতা দে, তুই বাবা পারোকে বিয়ে কর।” বললেন অনুপমা।

“কী বলছ মা তুমি এসব! ওর তো সেই কবেই বিয়ে হয়ে গেছে, আমার তখন এমএসসি ফার্স্ট ইয়ার।”

“আহহ থাম তো, সেই কবেকার কী পুরোনো কথা নিয়ে এখনও বসে আছিস বাপু। জানিস মেয়েটার উপর দিয়ে কী গেছে, আহা ওমন লক্ষ্মী মেয়ে… এই শোন, আমি আর অত বকতে পারছি না, যা তোরা দু’টিতে একটু বাইরে দিয়ে ঘুরে আয় দেখি… যা যা।”

দেবদত্ত কী, বলবে কীভাবে বলবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষে কান্না জমে ভারী হওয়া গলার স্বর, যথাসম্ভব লোকাবার চেষ্টা করে কোনোরকমে সে বলল, “এসো…”

ভেজা দু’চোখে সেই প্রথমদিনের মতো উপচে পড়া হাসি নিয়ে দেবদত্তের বাড়ানো হাতে, হাত রাখল পারমিতা।

পড়ন্ত বিকেলে পার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে—পারমিতার বিয়ে, শারীরিক সমস্যার জন্য সে কোনোদিন মা হতে পারবে না বলে নানা অত্যাচার, শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স… সবটুকু শোনার পরে, শুরু হল তাদের এতবছরের জমে থাকা যত কথা আর মান অভিমানের পালা; পারমিতার কাঁধে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল দেবদত্ত, তারপর বলল, “সব ‘দেব-পারো’র গল্প এক হয় না; কী? সত্যি সত্যিই গল্প পাল্টে গেল তো?”