সেদিন গুরুদেবের আবির্ভাব দিবস। বসার‌ ঘরে ঢুকতেই, মাথার ওপর গুরুদেবের বিরাট ছবি ক’দিন হলো টাঙানো হয়েছে। বড় রজনীগন্ধার গোড়ের মালা এসে গেছে। কিন্তু মালা পরাতে গিয়ে, এক অদ্ভুত কান্ড। ছবিতে কারেন্ট মারছে! প্রথমে আমার হাতে লেগেছে। মেজকাকা পুলিশে কাজ করে।  মানে, সরকারি মস্তান। আগ বাড়িয়ে এগিয়ে এল। যত্ত সব বুজরুকি! আমাকে সরিয়ে উঠল মালা পরাতে। পরক্ষণেই  চক্ষু চড়কগাছ! “বাবা গো…” বলে নেমে এল।

স্বীকার করল, সত্যিই কারেন্ট মারছে। বাবা, জ্যাঠা গম্ভীর। পরখ করতে চাইল না। বড়দা, মানে আমার জ্যেঠতুতো দাদা, রসায়ন নিয়ে অনার্স পড়ছে। সব শুনে বলে উঠল, “গল্প বানাবার একটা সীমা থাকা উচিৎ, তোদের কি সামান্যতম বিজ্ঞানবোধ নেই! ছবি কারেন্ট মারছে! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা বিশ্বাস করতে হবে?”  আমরা সবাই চুপ। নিজেই মালাটা নিয়ে উঠল। তারপরেই মুখ চুন। মাথা নামিয়ে,  আস্তে করে নীচু স্বরে বলল, “এটা কী করে সম্ভব? এর ব্যাখ্যা আমার মাথায় ঢুকছে না।”

এইবার আসরে নামল মা, জ্যেঠিমা আর ঠাকুমা। কাকিমা পিছনে একটু চুপচাপ। ঠাকুমা আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, “ও তোদের মোটা মাথায় ঢুকবে না। আজ গুরুদেবের আত্মার আবির্ভাব ঘটেছে, আমাদের বাড়িতে। ওই ছবির মধ্যে। তোরা নাস্তিক। তোরা এ’সবের মানে বুঝবি না।”

কারও মুখে কোনও উত্তর নেই। আলোর গতিতে খবরটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল পাড়ায়। সবার কাজকর্ম মাথায় উঠল। দলে দলে লোক বাড়িতে। অলৌকিক ছবি দেখতে। কেউ মিষ্টি, কেউ ধূপ, কেউ মালা নিয়ে হাজির। সবাই প্রণাম করে, নানারকম ‘মানসিক’ করে যাচ্ছে। কে একজন আবার শেষে মোক্ষম উপকারটা করে দিল, একটি টিভি চ্যানেলকে ফোন করে। ব্যস! আর রক্ষে নেই। এসে গেল মিডিয়া। গণেশের দুধ খাওয়ার অনেকদিন পর একটা হটকেক নিউজ। হৈ হৈ কান্ড। আত্মীয়-স্বজন সবাই জেনে গেল। ফোনের পর ফোন। সবার একটাই কৌতূহল। একবার যাব দেখতে। ছবিতে একটা প্রণাম করে আসব। এ তো সাক্ষাৎ ঐশ্বরিক ব্যাপার!

কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল ঠাকুমা।

জ্যাঠামশাই’র দিকে তাকিয়ে আদেশ দিলেন, “গুরুদেবের একটা বড় করে আবির্ভাব দিবস পালন করতে হবে। মানে, নর-নারায়ণের সেবা।”

বাবা-জ্যাঠারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। একটা ছবি, কী ঝামেলাতেই না ফেলল! এখন ঠাকুমার কথা ফেলাও যাবে না। মোটামুটি একটা হিসেবে বসল, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব মিলে শ’পাঁচেকের নিচে নামানো যাচ্ছে না। উপায় নেই। বাধ্য হয়ে ক্যাটারারের ডাক পড়ল। কাজের দায়িত্বও ভাগ হল। আমার ঘাড়ে পড়ল, আলোকসজ্জা আর শব্দদূষণের। ঠাকুমার কড়া নির্দেশ আমাকে, “বাসু, আলো দিয়ে সারা বাড়ি সাজাতে হবে, আর জোরে সব ভক্তিগীতি বাজবে। যাতে সারা পাড়ার লোক শুনতে পায়।”

বাধ্য হয়ে খবর দিলাম প্রদ্যুৎদাকে। এ’পাড়ায় উনিই বিদ্যুৎমন্ত্রী। যে কোনও কাজেই উনি ডাক পান। লাফিয়ে চলে এল। এসেই প্রশ্ন, “কীসের অনুষ্ঠান? সেই থিম বুঝে তো লাইটিং করতে হবে।”

আমি বললাম, “ছবিতে কারেন্ট।”

পুরোটা শুনে তো অবাক। আমাকে বলল, “কেসটা একবার দেখব?”

– “এখন! ক্যাটারার রান্না চাপিয়ে দিয়েছে, লোকজন সব আসতে শুরু করেছে। সন্ধেবেলা ভুঁড়িভোজ।  আর দেখে লাভ কী?”

চুপ করে রইল প্রদ্যুৎদা। লাইট, মাইক সব লাগিয়ে দেওয়ার পর ফিসফিস করে আমাকে বলল, “ছবি টাঙাতে গিয়ে, এমন পেরেক মেরেছে, কনসিল ওয়্যারিঙের পাইপ ফাটিয়ে একদম মেনলাইনে ঠেকে আছে। ঠিক করে দেব?”

– “খবরদার না। গুরুদেব এ’বার সত্যিই রেগে যাবেন। জয় গুরুদেবের জয়।”

মাইকে বেজে উঠল, “তুমি আছো, কি না বলো… ভগবান, আজ তোমার পরীক্ষা… ভগবা…ন।”