দিক-দিগন্তহীন একটা প্রকাণ্ড মাঠ। চরাচরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নয়। মাথার ওপরে আকাশ নেই, চাঁদ নেই, তারা নেই, নক্ষত্রদের স্মিতহাস্যময় আলো নেই, আছে শুধু অন্ধকার। এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে জায়গায় কীভাবে এসে পৌঁছল পৌষালী?  

মাঠের ওপর সাদা রঙের একটা কিছু পড়ে আছে, অনেকটা দূরে। পৌষালী ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেটার দিকে, ভয় ভয়ে। কাছে গিয়ে দেখল, একটা ধবধবে সাদা কাপড় পড়ে আছে। না, পড়ে নেই, কিছু একটা ঢাকা আছে চাদরটা দিয়ে। মানুষ?

হাত দিয়ে চাদরটা সরিয়ে দেখবে কি না ভাবছিল পৌষালী, এমন সময় দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল সেটাকে। বাতাসে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল চাদরটা। মাঠের ওপর পড়ে রইল শুধু একটা মানুষ— মৃত, ফ্যাকাসে, রক্তহীন। পৌষালী আর্তনাদ করে বলে উঠল, “দাদা!” তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মনীন্দ্রর বুকের ওপর। 

নন্দিনী ঘরেই ছিল। কালকের শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছিল আলনায়। পৌষালীর চিত্‍কারে সে চমকে ফিরে তাকাল তার ননদের দিকে, বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কী রে, কী হল! স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?”

বিছানায় উঠে বসেছে পৌষালী, তার অন্তর্বাসহীন রাতপোশাক ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। নন্দিনী বসল তার পাশে। পৌষালীর পিঠে হাত রেখেই হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “এমা, জামাটা তো ভিজে গেছে রে! যা, এবার ওঠ তো, সাড়ে আটটা বাজে, আর কত ঘুমোবি, পলি?”

পৌষালী উঠল না, কোনও কথাও বলল না, তার বৌদির কোলে মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়ল। নন্দিনী ননদের মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলল, “শ্বশুরবাড়িতে এই সাড়ে আটটা পর্যন্ত ঘুমোলে চলবে? তাড়িয়ে দেবে।” হাসতে থাকে নন্দিনী।

পৌষালী এসব কথার কোনও উত্তর দিল না। জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বৌদি, তুমি দাদাকে ভালবাসো?”

নন্দিনী এমন বেমক্কা প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে বলল, “মানে? এ আবার কেমন প্রশ্ন? ভালবাসব না কেন রে, সে আমার স্বামী!”

পৌষালী বলল, “স্বামী হলেই কী ভালবাসা যায়? দাদা কি একটা মানুষ? ও তো একটা জড় পদার্থ। তুমি এই বিয়েটা করলে কেন, বৌদি?”

অট্টালিকা তৈরির কোনও উপাদানই যার কাছে সহজলভ্য নয়, সে মনে মনে বালু দিয়েই তা গড়ে নেয়। তারপর বালু দিয়েই উঁচু প্রাচীর তুলে দেয় সেই অট্টালিকার চারপাশে। নিজেকে নিরাপদ মনে করে। যে লোকটি খড়ের ঘরে বাস করে সে কোনও রকমে একবার সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেই মনে করে যে, এই খড়ের বেড়া ভেদ করে পৃথিবীর কোনও শক্তিই তার কাছে পৌঁছতে পারবে না। এই মনে করাটুকুই তার সম্বল, কারণ এ ছাড়া তার কাছে আর কোনও বিকল্প নেই। মিথ্যাই এক্ষেত্রে সত্যের বিকল্প হয়ে ওঠে। যেন কালো দিয়ে সাদার অভাব পূরণ করা।

নন্দিনীও বেশ মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। তার অকর্মণ্য, অলস, হতাশাগ্রস্ত স্বামীকে অবলম্বন করেই এই বাড়িটাকে সে নিজের বাড়ি বলে ভাবতে অভ্যাস করেছে, এই বাড়ির মানুষগুলোই আজ তার আত্মীয়, নিজের মানুষ। কিন্তু পৌষালীর এই প্রশ্নে সেই বালুর প্রাচীর যেন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল খানিকটা। গলার কাছে চাপ বেঁধে উঠল এক দলা অভিমান। ভারী গলায় নন্দিনী বলল, “আমাদের মতো মেয়েরা কখনও নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে না, পলি। তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। আমার কি বিয়ে করার স্বাধীনতা ছিল? মা নেই, বাবা নেই, মামা-মামির কাছে বড় হয়েছি, তারা যেখানে বিয়ে দিয়েছেন সেটাকেই মেনে নিতে হয়েছে। আর কতদিন ওরা পুষবেন আমাকে?”

নন্দিনী কি একটু বেশি কথা বলে ফেলেছে? মনের ভেতরে চেপে রাখা কথাগুলো এভাবে ফাঁস করে দেওয়া কি ঠিক হল? পরিবেশ হালকা করার জন্য সে তাই তাড়া দিল পৌষালীকে, “নে, ওঠ তো এবার। দেখ কত বেলা হল। হ্যাঁ রে, তুই আজ পড়াতে যাবি না?”

“হ্যাঁ, যাব”, বলল পৌষালী। তারপর বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “আমাদের দেশে মেয়েরা খুব সস্তা, বৌদি।”

বারান্দায় একটা টুলের ওপর বসে আছে মণীন্দ্র। মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে আছে, চোখ দুটো আধ-বোজা, হাত দুটো কোলের ওপর জড়ো করে রাখা।

পৌষালী দাদাকে দেখে চমকে ওঠে। কাছে গিয়ে ভালো করে মুখের দিকে তাকায়। আশ্বস্ত হয় সে… নাহ! মণীন্দ্রর মুখটা বিবর্ণ আর বিষন্ন বটে, তবে মৃতের মতো ফ্যাকাশে নয়। মণীন্দ্র জীবিত, মৃত নয়। ভোর বেলায় দেখা স্বপ্নটাকে ভুলে যেতে চায় পৌষালী।

বিরস আর হতাশাপূর্ণ গান, কবিতা, এইসব মণীন্দ্রর পছন্দ। মুখে অনর্গল হতাশার সংলাপ, “আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় মরে যাই…”

স্কুলে পড়ার সময় বেশিরভাগ পরীক্ষাই দেয়নি মণীন্দ্র, এখানে ওখানে ঘুরে সারাদিন কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে বসে থেকেছে। যে দু’একটা পরীক্ষাতে বসেছে সেগুলোতেও খাতার পাতায় উত্তর লেখার বদলে আঁকিবুকি করেছে শুধু। মুখে শুধু একটাই বুলি, “আমার কিস্যু ভাল্লাগে না!” মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি মণীন্দ্র। ডাক্তার দেখানো হয়েছে কয়েকবার, ওষুধও খেয়েছে, কিন্তু বিশেষ কিছু কাজ হয়নি।

দাদাকে একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়েছিল মা। মায়ের ধারণা হয়েছিল, বিয়ে করলে হয়তো এই বিষন্নতা কেটে যাবে ছেলের। সংসারে মন বসবে, কাজ-কর্মের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু সবটাই ওই হয়তো-র পর্যায়েই থেকে গেছে, বাস্তবে সম্ভব হয়নি। এজন্য মায়ের ওপর এখনও রাগ হয় পৌষালীর। মা বলেছিল, “আমরা তো চিরদিন থাকব না, তোরও একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলেটকে দেখবে কে?”

পৌষালী বলেছিল, “দাদাকে দেখার জন্য যাকে নিয়ে আসবে তাকে দেখবে কে? দাদার মতো একটা জড়পদার্থ, উদ্যমহীন, অকর্মণ্য, হতাশাগ্রস্থ মানুষকে নিয়ে সে জীবন কাটাবে? মেয়েরা খুব সস্তা, না মা? তোমার মেয়েকে পারবে এরকম একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে?”

কিন্তু তাদের অবস্থা তো নন্দিনীর মতো নয়। খুব বিরাট কিছু না হলেও খেয়ে-পরে চলার মতো সংস্থান তাদের আছে। পৌষালী বলেছিল, “আর ওদের এই দারিদ্রের সুযোগটা তুমি পুরো মাত্রায় নিয়ে নিলে, তাই না?”

কিন্তু মা তো আর বেঁচে নেই, এখন রাগ করে লাভ কী?

দু’জন বন্ধুর সাথে পৌষালী একটা টিউটোরিয়াল ক্লাস খুলেছে। শুধু আর্টস গ্রুপ পড়ানো হয়। পৌষালী সেখানে ইতিহাস পড়ায়। সে খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। এবার সে বের হবে, তবে বেরোবার আগে বাবাকে ওষুধ খাওয়ানোটা তার দায়িত্ব। পৌষালী বাবার ঘরে গিয়ে বলল, “বাবা, উঠে বসো, ওষুধ খেতে হবে।”

মেয়ের ডাকে বাধ্য ছেলের মতো উঠে বসে বুড়ো ধনঞ্জয় পাল। মুখ হাঁ করে বসে থাকে। পৌষালী গেলাস নেয়, জল ঢালে, ওষুধ বের করে, ওষুধের কৌটোটা আবার গুছিয়ে রাখে। কিন্তু ধনঞ্জয় মুখ হাঁ করেই থাকে এতক্ষণ। মেয়ে এসে মুখে ওষুধ আর জল ঢেলে দিলে তারপর মুখ বন্ধ করে ওষুধ গিলে নিল। তারপর কঙ্কালের ওপর চামড়া দিয়ে ঢাকা শরীরটা আবার এলিয়ে দিল বিছানার ওপর। অস্পষ্ট জড়ানো গলায় বলল, “ছেলেটাও আমার অপদার্থ… তোর জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না রে, মা। আমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি নিজেই একটা …”

বাবার মুখোমুখি হলেই ওই একটা কথাই বলে। বাবার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে কী করত বাবা? তার বিয়ের ব্যবস্থা করত? পৌষালী ভাবে, কী জানি… হয়তো করত। মেয়ের জন্য বাবা-মায়ের কিছু করা মানে তো একটা সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া মেয়ের জন্য আর কোন স্বপ্নই বা দেখে আমাদের বাবা-মায়েরা? কিন্তু পৌষালীর দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাকে এবার বেরোতে হবে।

নিজের ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কলমটা পেল না পৌষালী। চিত্‍কার করে জিজ্ঞেস করল নন্দিনীকে, “বৌদি, আমার কলমটা দেখেছ?” অনেক দূর থেকে উত্তর এল, “না তো, জানি না।”

পৌষালীর মনে পড়ল, দাদা মাঝে মাঝে কলম দিয়ে কী সব যেন লেখে। সে দাদার ঘরে ঢুকল, ড্রয়ার খুলল। অনেক ঘেঁটেও কলমটা পেল না বটে, তবে ড্রয়ার উপচে মেঝেতে পড়ল একটা সাদা রঙের খাম। কীসের খাম এটা? কৌতূহলবশত ধীরে ধীরে খামটা খুলল সে। আর খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একগাদা ওষুধের স্ট্রিপ।

দাদা বিবাহিত, ঘরে বৌদি আছে, এভাবে ড্রয়ার খুলে কাগজ-পত্র বা ওষুধ কোনও কিছুই নাড়াচাড়া করা উচিত নয়। অনেক দ্বিধা নিয়ে একটা স্ট্রিপ সে চোখের কাছে এনে পড়ার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, এই ওষুধ চেনে সে, ঘুমের ওষুধ। খুব চড়া ডোজের ধুমের ওষুধ। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটা। হাতের আঙুলগুলো কাঁপতে শুরু করল পৌষালীর, বুকের ভেতরে একটা দুম-দুম শব্দ। এতগুলো ঘুমের ওষুধ কে রেখেছে? বৌদি ঘুমের ওষুধ খায় এমন তো সে শোনেনি। তবে কি দাদা… সারাদিন সে শুধু বলে, আমার কিছু ভাল্লাগে না, ইচ্ছে করে মরে যাই।

পৌষালী ওষুধের স্ট্রিপগুলো হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বসেই থাকে, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।

রাত প্রায় দেড়টা, বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোয়নি শুধু মণীন্দ্র, বিছানায় শুয়ে সে এপাশ-ওপাশ করছিল, বোধহয় সকলের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। পাশেই অঘোরে ঘুমোচ্ছে নন্দিনী, তার নাসিকা গর্জনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

এবার ধীরে ধীরে উঠে বসল মণীন্দ্র, অপলোক চেয়ে রইল নন্দিনীর দিকে। তারপর খাট থেকে মেঝেতে পা রাখল, উঠে দাঁড়াল সটান। আরও একবার নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে সে এগিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের দিকে, টানল ড্রয়ারটা। সেখান থেকে বের করল একটা সাদা খাম, আর খামের ভেতর থেকে কতগুলো ট্যাবলেটের স্ট্রিপ।

এখন তাকে দেখলে কেউ বলবে না যে, সে একটা কুঁড়ে লোক, একটা অকর্মণ্য হতাশাগ্রস্থ ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। ঘরের আবছা আলো-অন্ধকারে তাকে দেখে মনে হচ্ছে একটা দীর্ঘদেহী কর্মঠ সটান পুরুষ মানুষ।

নিঃশব্দে আর নিপুণ দক্ষতায় একটা একটা করে ট্যাবলেট হাতের তালুতে রাখল মণীন্দ্র। জলের গ্লাসটা টেনে নিল। একসাথে চার-পাঁচটা করে ট্যাবলেট মুখে ফেলে জল দিয়ে গিলতে লাগল। এইভাবে সবগুলো, অর্থাৎ প্রায় চল্লিশটা চড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ সে গলাধঃকরণ করে ফেলে আবার আস্তে আস্তে নিঃশব্দে নন্দিনীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

মণীন্দ্রর মুখে একটা প্রশান্তির হাসি ছেয়ে আছে। যেন বহুকালের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে যাচ্ছে সে, যেন কোনও বিশেষ কাঙ্খিত গন্তব্যে সে যাত্রা করবে এক্ষুনি। আলগোছে তার ডান হাতটা রাখল বুকের ওপর জড় করা নন্দিনীর হাতের ওপর। অস্ফুটে বলল, “আমাকে ক্ষমা কোরো। ভালো থেকো।” তার দুই চোখ বেয়ে প্রবল ধারায় নেমে এল অশ্রু।

চোখ বন্ধ করল মণীন্দ্র, ঘড়িতে তখন পৌনে দুটো।

পরদিন সকালে বারান্দায় টুলটার ওপর বসে ছিল মণীন্দ্র। তার পরনে সাদা রঙের থান, মাথার চুল এলোমেলো, হাতে গোল করে পাকিয়ে ধরা একটা কুশ-আসন। পাশে মেঝেতেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে নন্দিনী। তার পরনে একটা লালপেড়ে সাদা কাপড়, দুই চোখ জলে টলটল, যেন একটুখানি বাতাস লাগলেই গাল বেয়ে নামবে ঝরঝর করে। ভেতরে ঘরে বিছানার ওপর উপুর হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পৌষালী। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার শরীরটা।

কাল রাতে এ বাড়িতে মৃত্যুর যে দ্যূত এসেছিল তার বিবেচনা-বোধ প্রখর। আটত্রিশ বছর বয়সী মণীন্দ্রকে সে নেয়নি। নিয়ে গেছে আশির ঘরে পৌঁছানো হাড়-জিরজিরে ধনঞ্জয় পালকে, স্বাভাবিক জীবনযাপন যার পক্ষে আর কোনও দিনই সম্ভব ছিল না। এ জীবনে মেয়ের জন্য তার আর কিছু করা হল না। ঘুমের মধ্যেই মরে পড়ে ছিল ধনঞ্জয়। ডাক্তার বলেছে— ম্যাসিভ হার্ট এটাক।

ওদিকে হিসেব মিলছে না মণীন্দ্রর। চল্লিশটা ঘুমের বড়ি সে বেমালুম হজম করে ফেলল? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? কয়েক মাস ধ’রে বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে অনেক কৌশল করে সে সংগ্রহ করেছিল ওগুলো। সবকটা দোকান তাকে ঠকিয়েছে? তাও কি সম্ভব? মিলছে না, মণীন্দ্রর হিসেব মিলছে না। যে চিতায় আজ তার পুড়ে ছাই হবার কথা ছিল সেই চিতায় সে পুড়িয়ে এল তার বাবাকে। মণীন্দ্র বুঝতে পারে না, সে কী বাবার জন্য শোক করবে, নাকি নিজের জীবন ফিরে পাবার জন্য আনন্দিত হবে। কিন্তু সে তো নিজেই মরতে চেয়েছিল।

আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল মণীন্দ্র। মেঘহীন নীল আকাশ, খুব নীচু দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক সাদা ধবধবে বক। আকাশ এত সুন্দর? মণীন্দ্র তো ভালো করে আকাশ দেখেনি কোনোদিন। সে কি এবার নিজেকে বদলে নিতে পারবে? বাবার অবর্তমানে সে-ই এখন বয়োজ্যেষ্ঠ, সে-ই সকলের অভিভাবক। এই গুরুদায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নেবে কি না আমরা জানি না, শুধু সময় জানে।

সন্ধেবেলায় বারান্দায় বসে ছিল পৌষালী। দাদাকে সে মৃত্যুর ঘাট থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল ঠিকই, কিন্তু বাবাকে হারাতে হল। মৃত্যু কি বিনিময় প্রথায় বিশ্বাসী?

ঘুমের ওষুধগুলো বদলে দিয়েছিল পৌষালী, তার এক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বন্ধুর সাহায্যে। আসল ওষুধগুলোর জায়গায় রেখে দিয়েছিল অবিকল একইরকম দেখতে গ্লুকোজ জাতীয় কিছু ট্যাবলেট। অনেক দুঃখের মধ্যেও আনন্দের একটা চোরা স্রোত থেকে থেকে জেগে উঠছে তার মনের মধ্যে। দাদা ফিরে এসেছে, যেন চিতার ভেতর থেকে ফিরে এসেছে সে ফিনিক্স পাখির মতো। অন্তত এ যাত্রায় তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

ঘরে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করছিল পৌষালী, হঠাৎ বাইরে রাস্তার দিক থেকে কে যেন ডাকল, “পলি…”

বাবার কণ্ঠ চিনতে অসুবিধে হল না পৌষালীর। একটু চমকে উঠলেও সে ভয় পেল না। জানালায় মুখ ঠেকিয়ে সে-ও ডাকল, “বাবা …”

ঘরে কিংবা বাইরে, কোথাও থেকেই কোনও উত্তর এল না।