সুমিতা আজকাল আর কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না। নানা চিন্তাভাবনায় অস্থির হয়েছে কখনও কখনও। অলোকেশের শরীর খারাপ হলে অস্থির হয়ে উঠত সুমিতা। অবশ্য কোনও কিছু হলেও বুঝতে দিত না অলোকেশ। একটু বাড়াবাড়ি হলে ধরা পড়ত সুমিতার কাছে। সেবা-যত্নের কোনও ফাঁক রাখত না সে। ঘড়ি ধরে একটার পর একটা ওষুধ এগিয়ে দিত অলোকেশের হাতে। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক রেখেছিল ডাক্তারবাবু যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি। বিকেল হতে না হতেই ফল খেতে হত অলোকেশকে। এক থালা ফল নিয়ে ঘরে ঢুকলেই অলোকেশ বলে উঠত, “ওরে বাবা, এত ফল একা খাওয়া যায় নাকি! তুমিও এর থেকে নাও।”
সুমিতা সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ধুর, আমার খাওয়ার দরকার নেই। আস্তে আস্তে বসে খেয়ে নাও।”
আলোকেশ এবার কাঁপা কাঁপা গলায় একটু গলা তুলে বলে, “সৌমি, এদিকে আয়।”
সৌমি পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে বলে, “না, না, আমি খাব না।”
আলোকেশ শুকনো মুখে ঠোঁটে আলতো হাসি এনে বলে, “মেয়েটাও আজকাল একদম কথা শোনে না।”
সুমিতা হেসে ফেলে।
দিনে দিনে অলোকেশের শরীরের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সুমিতা হাল ছাড়তে রাজি নয়। ডাক্তার, ওষুধ— সব দিকে তীক্ষ্ণ নজর। সংসারের কাজ সামলে এক এক সময় দিশেহারা লাগে সুমিতার। সে অবশ্য মেয়েকে কোনও টেনশন দিতে চায় না। সৌমিও সব বুঝতে পারে। সেও কলেজ, পড়া সেরে যতটুকু সময় পায়, মাকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে।
এমন অবস্থা তো ছিল না আগে। কাকু, কাকিমা, ভাই-বোনদের মাঝে বড় হচ্ছিল সে। যখন বুঝতে পারার বয়স, তখনই দোতলায় উঠে গেল ওরা। কাকুরা নীচের তলায়। দোতলা থেকে যাতায়াতের জন্য বাড়ির গা ঘেঁষে উঠেছিল সিঁড়ি। মাঝে মাঝে মা কেমন যেন ব্যবহার করত ভাই-বোনদের সঙ্গে। সৌমি তেমন কিছু না বুঝলেও, দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে জীবন। ভাই-বোনেরা এখন আর কেউ ওপরে আসে না। অন্যদিকে সৌমিও যেতে পারে না। কখনও কখনও ইচ্ছে হলে মায়ের কাছে ইচ্ছাপ্রকাশ করলে মা রাগ করে বলে, “ঘরে বসে স্কুলের হোমটাস্ক করো। এখন কোথাও বেরোতে পারবে না।”
সৌমি ভাই-বোনদের মধ্যে বড়। ছোট ছোট ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য ছটফট করত। বাবাও আজকাল কেমন চুপচাপ থাকেন। কথা বেশি বলতে চান না। সৌমির খুব ইচ্ছে করে আবার আগের মতো সবার সঙ্গে থাকতে। এখন আর কেউ কারও খোঁজখবর রাখে না। উৎসব, অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে মনখারাপ হয় সৌমির।
ওই বয়সে কিছু বুঝতে পারেনি সৌমি। কে দায়ী এরকম পরিস্থিতির জন্য? চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও কোনও কুল-কিনারা খুঁজে পায়নি।
আলোকেশ চলে যাওয়ার এক বছর পার হতেই সৌমির বিয়ের জন্য উঠে-পড়ে লাগে সুমিতা। এক-এক সময় কিছু্ই ভালো লাগে না। মেয়েটার জন্য আজকাল ভীষণ চিন্তা হয়। যখন সৌমি কলেজে থাকে, স্নান, খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বিছানায় চুপ করে বসে সুমিতা। খাটের পাশেই ফ্রেমে বাঁধানো অলোকেশের ছবিটার দিকে চোখ যায়; সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুঁকরে কেঁদে ওঠে। ফটোটার দিকে তাকিয়ে ভাঙা স্বরে বলে, “তুমি তো বেশ নিশ্চিন্তে আছ। এখন সব দায় তো আমার; আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে তো কিছুই ভাবতে হল না তোমাকে। স্বার্থপর কোথাকার…”
আর বলতে পারে না। কান্নায় গলা বুজে আসে।
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের দেখলেই মেয়ের জন্য পাত্র দেখে দেওয়ার কথা বলে। এতে অসন্তুষ্ট হয় সৌমি। এক রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মাকে বলে, “সবাইকে এভাবে বলছ কেন? আমি কি গলার কাঁটা হয়ে গেছি?”
সুমিতা মেয়েকে কিছু বলতে পারে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সৌমিও আর কথা বাড়ায় না।
হঠাৎই একটা যোগাযোগে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় সৌমির। একান্নবর্তী পরিবারে মেয়ে গিয়ে কীভাবে মানিয়ে থাকবে, তা নিয়ে চিন্তা হলেও সরকারি চাকরি করা পাত্রকে হাতছাড়া করতে চায়নি। পাত্রের বয়স একটু বেশি হওয়ায় অনেকের অনেক মন্তব্য শুনতে হয়েছিল। কিন্তু সুমিতা সেসব কথা কানে শুনলেও তেমন পাত্তা দেয়নি। অলোকেশের রেখে যাওয়া শেষ সম্বলটুকুও উজাড় করে দিয়েছিল সৌমির বিয়েতে।
বিয়ে-পর্ব শেষ হতেই একেবারেই একা হয়ে যায় সুমিতা। দিনে দিনে নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরতে থাকে। রোজ রাতে ফোনে কথা হয় সৌমির সঙ্গে। সৌমি অবশ্য কয়েকদিন তার কাছে গিয়ে থাকতে বললেও, রাজি হয় না। স্বামীর ভিটে-সংসার ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় সে। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠলে সৌমিকে কয়েক দিনের জন্য এসে থাকার কথা বলে।
সৌমি খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলে, “এখানে অনেক কাজ করতে হয় আমাকে; বাড়ির বড় বউয়ের যে অনেক দায়িত্ব মা। তোমার জামাইয়ের দেখাশোনার পাশাপাশি দেওর-ননদের নানা বায়নাক্কা মেটাতে হয়। জানো মা, সবার সঙ্গে বাঁচার আনন্দই আলাদা। সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। সংসারের নানা কাজে কখন যে রাত গভীর হয়ে যায়, তা আর খেয়াল থাকে না। লম্বা বারান্দা, একটার পর একটা ঘর— সেই আমাদের স্কুল বাড়ির মতো। কিন্তু সেই ঘরগুলোতে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। জানো মা, সেদিন রাতে তোমার জামাই বলছিল, ‘মাকেও নিয়ে আসি আমাদের বাড়িতে, সবাই একসঙ্গে থাকব’।”
কথাগুলো নীরবে শুনে যাচ্ছিল সুমিতা। এবার নীচু স্বরে বলে, “আসলে, কী জানিস…”
ওপার থেকে সৌমি বলে ওঠে, “জানি। তুমি একা থাকতেই তো ভালবাসো, নিঃসঙ্গতাকে আঁকড়ে ধরেই তো বাঁচতে চাও। সেটা বাঁচার মতো বাঁচা কি?”
ফোনটা কানে ধরে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে সুমিতা।
কমেন্টস
Khub bhalo